ভোটে গণ্ডগোল হবে, সে তো জানা কথা। পাঁচ বা ছয়ের দশকেও হত। তবে লাশ পড়ার মতো ঘটনা ঘটত না বড় একটা।
টাইগার হল-এ ম্যাটিনি শোয়ে অড্রে হেপবার্ন আর উইলিয়াম হোল্ডেনের ‘স্যাব্রিনা’ ছবিটা দেখে বেরিয়ে এসে চৌরঙ্গির দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেলাম! চির ব্যস্ত রাস্তাটা জনশূন্য, গাড়িটাড়ি উধাও। চার দিক সুনসান, থমথমে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি, পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের কাছে বিশাল জনতা রাস্তা জুড়ে ভিড় করে আছে। সর্বত্রই এক-আধ জন সবজান্তা লোক থাকেন। তেমনই এক জন বললেন, ‘আরে মশাই, আজ বিধানসভা ভোটের কাউন্টিং, মনে নেই?’ মনে ছিল না। কিন্তু কাউন্টিং বলে গাড়িঘোড়া তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়! সুতরাং গুটি গুটি ও দিকেই এগোলাম। কিছুটা এগোতেই দেখলাম, ভিড়ের লোকজন হঠাৎ এ দিকেই ছুটে আসছে, পিছনে লাঠি উঁচোনো পুলিশ।
থেমে পড়লাম। দেখলাম, জনতা খানিকটা হটে এসে আবার পায়ে পায়ে অকুস্থলে ফিরে যাচ্ছে। অনিবার্য কৌতূহলবশে আমিও ফের এগিয়ে দেখি, সামনেটা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। লোকে বলাবলি করছে, মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় নাকি ভোটে হেরে যাচ্ছেন কোনও এক অখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মহম্মদ ইসমাইলের কাছে। শুনে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। জনতাও প্রবল উত্তেজিত। বিধান রায়ের ডান হাত বলে পরিচিত, বাহুবলী গোপাল মুখুজ্জেকে দেখতে পেলাম একটা জিপ হাঁকিয়ে গম্ভীর মুখে চলে গেলেন।
বিধান রায়ের সেই প্রায়-পতনের কারণ ছিল বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবে তাঁর সাগ্রহ উদ্যোগ। বামপন্থীদের এবং আমজনতার তীব্র বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়। বিধান রায় অবশ্য সে বার অল্পের জন্য বেঁচে যান মাত্র শ’পাঁচেকের মতো ভোটে জিতে। ঘটনাটার উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, এক-আধটা ভুল সিদ্ধান্ত অনেক অটল আসনও এক ঝটকায় টলিয়ে দিতে পারে। যেমন সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম বামফ্রন্টের মৌরসিপাট্টার অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিল।
যখন কলকাতার বাইরে অসম, উত্তর বাংলার বিভিন্ন রেলশহরে থাকতাম, তখন ভোটের উত্তেজনা তেমন টেরই পেতাম না। কলকাতায় এসে বুঝলাম, ভোট কাকে বলে! ভোট যে একটা অতি গুরুতর ব্যাপার, তা কতিপয় বামপন্থী বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে মালুম হল। আর রাতারাতি বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট হয়ে যেতেও দেরি হয়নি। বন্ধুদের প্ররোচনায় ছাপ্পা ভোট দিতেও বুথে হাজির থাকতাম। মনেপ্রাণে বামপন্থীদের জয় চাইতাম। কিন্তু লক্ষ্য করতাম, বামপন্থীরা মিছিল-মিটিং করলে প্রচণ্ড ভিড় হয়, বন্ধ ডাকলে তা একশো ভাগ সফল হয়, কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে তারা প্রবল জনপ্রিয়, কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে তারা হেরে যাবেই যাবে। এইটে ভারী ধাঁধাঁয় ফেলে দিত আমাকে। আমার বামপন্থী বন্ধুদের অনেকেই তৎকালীন অখণ্ড সিপিআই-এর মেম্বারশিপ পাওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করত।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কিন্তু মেম্বারশিপ পাওয়া নাকি এত কঠিন যে, দরখাস্ত করেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। পার্টি যে একটা লোকের কাছে কত ভালবাসার জিনিস হতে পারে, তা এই সব বন্ধুদের দেখে বুঝতাম। পার্টির কাছে তাদের কোনও প্রত্যাশা নেই। এক জন বলেছিল, ‘জানিস তো পার্টিতে ঢুকতে কষ্ট, ঢুকেও কষ্ট, পার্টি কিছু দেবে না, আমাকেই দিতে হবে রোজগারের অংশ, অবিচল আনুগত্য, যা বলবে তা-ই করতে হবে। তবু মাইরি, মেম্বারশিপ পাওয়া যায় না।’
ভোটে গণ্ডগোল হবে, সে তো জানা কথা। পাঁচ বা ছয়ের দশকেও হত। তবে লাশ পড়ার মতো ঘটনা ঘটত না বড় একটা। রাজনীতিতে পেশিশক্তির দাপট বড় কম ছিল না। গোপাল মুখুজ্জের কথা আগেই বলেছি। ছিলেন রাম চাটুজ্জে, দানু বোস, ভানু ও জগা বা এ রকম আরও কেউ কেউ। কিন্তু এঁদের আবার একটু রবিন হুডীয় ইমেজ ছিল। শোনা যেত, এঁরা দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করে থাকেন। এঁদের সম্পর্কে মহিলাঘটিত স্ক্যান্ডাল ছিল না, আর্থিক কেলেঙ্কারির কথাও শোনা যেত না। এঁরা ছাড়াও গুন্ডার অভাব ছিল না, কিন্তু পকেটে পকেটে পিস্তল বা আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যেত না তেমন। ভোটের সভাতেও বিস্তর হাজির থেকেছি। বাক্যবাণ অকৃপণ বর্ষিত হত বটে, কিন্তু ভাষার যে দূষণ আজকাল কানে আসে, তা অশ্রুত ছিল। আমার মনে হয়, নকশাল আন্দোলনের আগে মানুষের, সে যত বড় গুন্ডাই হোক, লাশ ফেলার প্রবণতা কম ছিল। নকশাল আমলই শিখিয়ে দিয়ে গেছে, লাশ ফেলাটা কোনও ব্যাপারই নয়। এখন সেই ট্র্যাডিশন বহন করে নিয়ে যাচ্ছে অগুনতি কিশোর-যুবা, যারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মশা-মাছির মতো মানুষ মারতে পারে।
নির্বাচন আসে-যায়। আমরা ভোট দিই বা দিই না, ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও ছিল না আমাদের। একটা নির্বাচন কমিশন আছে বলে শুনি, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোরও কোনও প্রয়োজন হয়নি কখনও। কিন্তু হঠাৎ টি এন শেষন নামে এক জন তামিল ব্রাহ্মণ এসে এমন শোরগোল ফেলে দিলেন যে, আমাদের নড়েচড়ে বসতে হল। আমরা ভোট দিতে গেছি হাতে বিভিন্ন পার্টির দেওয়া স্লিপ নিয়ে। আমাদের আইডেন্টিটি নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। ছাপ্পা ভোটারদেরও ভারী সুদিন ছিল তখন। অনেকেই বুথে গিয়ে জানতে পারত, তার ভোট পড়ে গেছে। অভিযোগ করে তেমন লাভ হত না। শেষন নির্বাচন কমিশনার হয়ে ক্ষমতায় এসেই নির্বাচন কমিশনের কী কী ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া আছে, তা খুঁড়ে বার করে আনলেন এবং সরকারের টনক নড়ে গেল। তাঁরই জোরালো সওয়ালে সরকারকে দেশ জুড়ে ভোটার কার্ড প্রদানের বিশাল খরচসাপেক্ষ কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হল এবং নির্বাচন চলাকালীন কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে নির্বাচন কমিশনের অনুশাসন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা জারি হল। নির্বাচন কমিশনের যে এত ক্ষমতা, তা আমাদের জানাই ছিল
না। শেষনের কড়াকড়িতে অনেক কায়েমি স্বার্থ ব্যাহত হচ্ছিল, ফলে তাঁকে বিস্তর হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনও করা হয়েছিল। কিন্তু লোকটি তাতে টলেননি। ভারতীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুদ্ধকরণ করেই ছেড়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন এখন যে সম্ভ্রমের আসনে অধিষ্ঠিত রয়েছে, তা শেষন সাহেবের একক অবদান। ৮৬ বছর বয়সী বিপত্নীক শেষন এখন চেন্নাইয়ের এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন বলে শুনেছি।
আগে ভোট এলে একটু উত্তেজনা হত। আজকাল দুশ্চিন্তা হয়, বডি কাউন্ট মাত্রা ছাড়াবে না তো! হিংস্রতা কত দূর ছড়াবে! শুনতে পাই, উন্নত দেশগুলিতে নাকি ভোটের কোনও আঁচই লোকে টের পায় না। দেওয়াল-লিখন নেই, লাশ ফেলার তো প্রশ্নই ওঠে না, ট্রেনে-বাসে-জমায়েতে ভোট বা রাজনীতি নিয়ে আলোচনাও নেই। কেউ ও সব নিয়ে মাথাই ঘামায় না তেমন। নিঃশব্দে ভোটটা দিয়ে আসে। ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত।
সাত দফার একটা লম্বা ভোটের মোচ্ছব দরজার কড়া নাড়ছে। তরজা শুরু হয়ে গেছে। বোকা বাক্সের সামনে জমাট বাঁধছে জনতা। যেন বা এ-ও এক আই পি এল ম্যাচ। ভরসা একটাই, ভারতবাসীকে এখন রঙিন কথায় ভোলানো যায় কমই। প্রয়োজনে তারা দান উল্টে দিতে পারে।