কালী লিম্বুনি ও তাঁর নাতিরা। নিজস্ব চিত্র
কালী লিম্বুনির কথা: রাস্তাটায় আসতে কষ্ট হল তো, সাহেব? এখন তো গাড়ি চলে। আগে আমাদের সময়ে হেঁটেই যাতায়াত করতাম। জ্যোতিবাবুও আমাদের এই বস্তিতে হেঁটেই এসেছিলেন। উনি আর আনন্দ পাঠক। সে কি আজকের কথা? সেই ’৫৫ সাল। সে বারেই আমাদের চা বাগানে পুলিশ গুলি চালাল, ছয় জন মারা গেল। জ্যোতিবাবু পুরো রাস্তাটা হেঁটে আসতে পারেননি, আমাদের কুলিবস্তির লোকেরা ওঁকে কাঁধে করে নিয়ে এলেছিল। আমি কি আর আজকের লোক?
আমার বয়স? তা ধরুন, ৭৫ হবে। বাবা অন্য বাগানে কাজ করত। এখানে যখন এলাম, এগারো বছর বয়স। এসেই বাগানের কাজে জুতে গেলাম। স্কুলে বেশি দূর যাইনি। ওই দু’ ক্লাস। তখন এই রকম কাঠের বাড়িও ছিল না। মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি। খাট, বিছানা আমরা কুলিবস্তির লোকেরা মেঝেতেই শুতাম।
সেটা সাহেবি আমল। বাগানে শুধু এলিগেন, ওখলেন (ওকল্যান্ড)... এই সব বড় সাহেবদের ঘোড়া ছিল। এখন তো লোকে গামবুট পায়। আমাদের খালি পায়েই কাজ করতে হত। শুধু সাহেবরাই পায়ে জুতো পরত, বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিত। ছাতাও মাথায় দেওয়া যেত না। বোনাস, হক ছুটি কিছুই ছিল না। আর ছিল হাট্টাবাহার। সাহেব চাইলে যখন-তখন কাউকে বাগান থেকে বার করে দিতে পারত। এরই নাম হাট্টাবাহার। এ সব শুনে কী করবেন সাহেব?
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গোর্খা লিগ আর সিপিআই তখন আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমরা ধর্মঘট ডাকি। তার পরই ওই ২৫ জুন, ১৯৫৫। বাগানে গুলি চলল। সামনের রাস্তাটা দিয়ে ওপরে উঠে যাবেন, ওখানে শহিদ বেদি আছে।
গুলিতে আমাদের মৌলি শোভা রাই মারা গিয়েছিল। ওর পেটের বাচ্চাটাও বাঁচেনি। ধর্মঘট, গুলি চলার পরই তো আমাদের অবস্থা বদলাল। বন্ধ হল হাট্টাবহার। বোনাস, মাতৃত্বকালীন ছুটি সব মেনে নিল দেশের সরকার।
মার্গারেটস হোপ চা বাগানে স্মৃতিস্তম্ভ। নিজস্ব চিত্র
সুমিত দেওয়ানের কথা: ঠাম্মা কী বলছিল? আগে কত খারাপ ছিল, এই সব ভ্যাজরং ভ্যাজরং তো? ওপরে হিলকার্ট রোডটা দেখবেন, সারানো হয়। আর সোনাদা থেকে বাগানে ঢোকার সাড়ে ৫ কিলোমিটার রাস্তায় আসতে আসতে বোল্ডার আর পাথরের নাচনকোঁদন তো নিজেই টের পেলেন। এখন ভোটের আগে কুলিবস্তির রাস্তা সারানো হচ্ছে। কিন্তু একশো দিনের কাজও এখানে লোকের জোটে না। মেরেকেটে চল্লিশ-পঞ্চাশ দিন। ওপরে সোনাদা যাওয়ার গাড়ি পাবেন সকাল সাতটা থেকে নয়টা অবধি। বিকেল ৪টে থেকে আবার গাড়ি নিজে নামতে শুরু করে। আমার ভাইটা দিলারাম বাগানের স্কুলে পড়ে। যেতে ৩০ টাকা গাড়িভাড়া, ফিরতে ৩০ টাকা। এখানেই ৬০ টাকা বেরিয়ে গেল। স্কুলে তাও ভাত, আলুর ঘ্যাঁট দেয়। সপ্তাহে একদিন ডিম। যা হোক, পেটটা ভরে।
আমার বাবা, মা দু’জনেই বাগানে কাজ করে। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা অবধি। ১৭৬ টাকা রোজ। ঠাম্মার খালি পায়ের গল্প রাখুন। এখন সবাই গামবুট পরে কাজ করে। বাগান সে জন্য ১০০ টাকা দেয়। এ দিকে দোকানে এক জোড়া গামবুটের দাম ২৫০ টাকা। ঠাম্মা বলছিল না, আগে সব খারাপ ছিল, আর এখন ভাল!
আমাদের বাগানের হাসপাতালে স্যানেটোরিয়াম ছিল, ছোটখাটো অপারেশন হত। এখন বেশির ভাগ দিন ডাক্তার থাকেন না।
জানেন, এই কারণে ক্লাস টেনের পর আমি কাজের খোঁজে চলে গিয়েছিলাম। কলকাতা, কেরলে সিকিওরিটি গার্ডের কাজ করেছি। তার পর ঘরে ফিরে এলাম। আমার পড়তে ভাল লাগত। কিন্তু আমাদের নেপালি সমাজে আবার বই পড়া কালচারটা নেই। সবাই গিটার বাজায়, ব্যান্ড তৈরি করে। আপনারা তো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের বিয়েতে উপহার দেন। আমাদের নেপালি সমাজের নিয়ম জানেন? উপহার দিতে হবে, সেই সঙ্গে ‘সরাও’। মানে, যার যা সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী টাকাও দিতে হবে।
আপাতত আমরা কয়েক জন বন্ধু, দাদাদের সঙ্গে মিলে এখানে ‘লালিগুরাস’ নামে একটা নেপালি পত্রিকা বার করি। মার্ক্সের ২০০ বছরে একটা সংখ্যাও বার করেছিলাম, আপনাকে দেখাব পত্রকারবাবু।
কী বলছেন? আমরা কোন পার্টি? না, আমরা সিপিএম, টিএমসি, বিজেপি, নকশাল, বিমল গুরুং কিছু নই। ভেবেছিলাম, বাগানে শ্রমিকদের জন্য একটা কো-অপারেটিভ তৈরি করলে ভাল হয়। কিন্তু সেটার জন্য একটা অফিসঘরের ঠিকানা লাগে, জমি লাগে। এখানে সবই বাগান-মালিকের বা দেশের সরকারের। আমাদের কথা কে ভাবে, বলুন?
সাংবাদিকের কথা: দার্জিলিঙের মার্গারেটস হোপ চা বাগানের বস্তিগাঁওয়ে নেওয়া সাক্ষাৎকার। ভোটের ওপারে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গণতান্ত্রিক আশাআকাঙ্ক্ষা, সমস্যা, সম্ভাবনা হয়তো এ ভাবেই এগিয়ে যায়। সেখানে সাংবাদিকী টীকা নিষ্প্রয়োজন।