পাকা রাস্তায় সবুজ সাথী, কিন্তু কাজ কই!

‘মাও-ভূমে’চোরা ক্ষোভ

লোকসভার যুদ্ধে জরুরি বিধানসভার অঙ্ক। সেই সমীকরণেই আনন্দবাজার পৌঁছে গিয়েছে জনতার দরবারে। তিন বছর আগের ভোটের পরে কী পেয়েছেন মানুষ, সাংসদ নির্বাচনের আগেই বা কী ভাবছেন তাঁরা, রইল বিধানসভাওয়াড়ি পর্যালোচনা।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:২২
Share:

কাজের সুযোগ কম। ঝাড়খণ্ডের হাটে কাঠ বেচে পেট চলে বেলপাহাড়ির বহু পরিবারের। নিজস্ব চিত্র

ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বেলপাহাড়ির ঢাঙিকুসুম যাওয়ার চওড়া রাস্তা হয়েছে পাহাড় কেটে। চড়াই-উতরাই পথে সাইকেল ঠেলে চিড়াকুটি হাটে যাচ্ছিলেন বছর তিরিশের লক্ষ্মণ সিংহ।

Advertisement

আবার তো ভোট এসে গেল?

আদিবাসী-ভূমিজ সম্প্রদায়ের লক্ষ্মণ একগাল হেসে জবাব দিলেন, ‘‘আগে এই রাস্তায় চলা যেত না, পাহাড়ি ঝোরায় তেষ্টা মেটাতে হত। এখন রাস্তা হয়েছে, গ্রামে গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। এলাকা বিলকুল বদলে গিয়েছে।’’

Advertisement

আর মাওবাদীরা?

এ দিক-ও দিক তাকিয়ে গলা নামল লক্ষ্মণের, ‘‘হয়তো আসেন, তবে দেখতে পাই না।’’

একদা মাওবাদীদের ধাত্রীভূমি বেলপাহাড়ি ব্লক পড়ে বিনপুর বিধানসভায়। জঙ্গলমহলে শান্তি আর উন্নয়নের অস্ত্রে মাওবাদীদের কোণঠাসা করার সাফল্য বারবার দাবি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তল্লাটে ঘুরেও চোখে পড়ছে রাস্তা ভাল হয়েছে, প্রায় সব স্কুলই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক হয়েছে, সবুজ সাথীর সাইকেলে স্কুলে যাচ্ছে ইন্দ্রাণী মুর্মু, সুরজ সিংহরা। মাও-পর্বে ভোট বয়কটের পোস্টার পড়া এলাকাগুলোয় চওড়া হয়েছে ভোটের দেওয়াল লিখন। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত, ২০১৪-র লোকসভা আর ২০১৬ সালের বিধানসভায় উপুড়হস্ত হয়ে তৃণমূলকে ভোটও দিয়েছে বিনপুর। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটে অবশ্য সেই জনসমর্থন কিছুটা চিড় খায়। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি আর স্বজনপোষণের জবাব ভোটে দিয়েছিলেন বাসিন্দারা। বেলপাহাড়ির শিমূলপাল, বাঁশপাহাড়ি আর ভুলাভেদা গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছিল অরাজনৈতিক আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ।

হিসেব বলছে, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিনপুর বিধানসভায় তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৫১.৯৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের বিধানসভায় তা বেড়ে হয় ৫৫.০২ শতাংশ। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ২৬.৬৮ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিনপুর বিধানসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র ১০.১০ শতাংশ। ২০১৬ সালের বিধানসভায় বিজেপি-র ভোটের হার কমে হয়েছিল ৮.৯০ শতাংশ। গত বছর পঞ্চায়েতে অবশ্য তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে কিছুটা ধস নেমেছে। বিনপুর বিধানসভায় মোট ২০টি গ্রাম পঞ্চায়েত। জামবনি ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭টি পেয়েছে তৃণমূল, ৩টিতে ক্ষমতায় বিজেপি ও নির্দলরা। আর বেলপাহাড়ি ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫টি তৃণমূলের। আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ চারটি ও বিজেপি একটি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

চোরা ক্ষোভ কি তবে মাথা তুলছে?

বিগত বছরগুলোতে তৃণমূল সাংসদ উমা সরেনকে দেখা যায়নি, এই অভিযোগ রয়েছে এলাকায়। রয়েছে অন্য কাজ না থাকার ক্ষোভও। বিরমাদলের প্রবীণা গঙ্গা সিংহের কথায়, ‘‘এলাকায় কাজ নেই। মরসুমে শালপাতা-কেন্দুপাতা তুলে আর বাবুই দড়ি পাকিয়ে, নয়তো জঙ্গলের কাঠ কেটে সংসার চলে। কাঠ বেচতে যেতে হয় ঝাড়খণ্ডের গন্ধনিয়া কিংবা ডাঙ্গারি হাটে।’’ স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, দু’টাকা কিলোর চালে পেট ভরছে ঠিকই, কিন্তু সংসারে স্বচ্ছলতা কই। চাষে বিঁধছে সেচের কাঁটা। রয়েছে হাতির উপদ্রব। ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আবার বড় অসুখের চিকিৎসা হয় না। আর দূরত্বের কারণে বেলপাহাড়ির গ্রামীণ হাসপাতালে যেতে চান না অনেকেই।

ধবাকাচা গ্রামের বছর কুড়ির কার্তিক বাস্কে মাধ্যমিকের পরে স্কুল ছেড়েছেন। ছাগল চরাচ্ছিলেন। বললেন, ‘‘কী হবে বেশিদূর পড়ে। এলাকায় তো কলেজ নেই। তার থেকে ভিন্‌ রাজ্যে শ্রমিকের কাজে নগদ মেলে।’’ কার্তিকের মতো এলাকার অনেক যুবকই কলকাতা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতে শ্রমিকের কাজ করতে যান‌। ভোট পরবে গ্রামে ফেরেন। বেলপাহাড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে সমতলের জামবনিতে নামলেও ক্ষোভের আঁচ টের পাওয়া যায়। চিল্কিগড়ে ডুলুংয়ের সেতু হয়নি। ভারী বৃষ্টি হলেই কজওয়ে ছাপিয়ে হড়পা বান বইতে থাকে। জামবনির বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে ব্লক সদর গিধনির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আদিবাসী সংরক্ষিত বিনপুর বিধানসভার মধ্যে রয়েছে বেলপাহাড়ি ও জামবনি ব্লক। দু’টি ব্লকে মোট ১২৭ কিমি ঝাড়খণ্ড সীমানা রয়েছে। এক সময় ওই সীমানা দিয়েই আনাগোনা ছিল মাওবাদীদের। মানুষে অপ্রাপ্তি, বঞ্চনার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সংগঠন গড়েছিল তারা। গত পঞ্চায়েতেও এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই মাথা তুলেছে বিজেপি ও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ। এ বার লোকসভায় অবশ্য ভূমিজ ও মুন্ডারা মঞ্চ ভেঙে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। বিজেপি, কংগ্রেস, বাম, এসইউসি, ঝাড়খণ্ডী— বিরোধী প্রার্থীও বিস্তর। ফলে, ভোট কাটাকুটির অঙ্কে তৃণমূল প্রার্থী বিরবাহা সরেনের লাভ হওয়ার কথা। তবে বিরোধীরা প্রচারে প্রকৃত উন্নয়নের অভাবকেই তুলে ধরছেন। বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম, কংগ্রেসের যজ্ঞেশ্বর হেমব্রম, সিপিএমের প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম একযোগে বলছেন, ‘‘দেখনদারি উন্নয়ন হলেও মানুষের প্রকৃত সমস্যা মেটেনি। গরিব আদিবাসী-মূলবাসীদের স্থায়ী কাজ, যোগাযোগের সেতু হয়নি।’’ তৃণমূল প্রার্থী পাল্টা বলছেন, ‘‘ধাপে ধাপে উন্নয়ন হচ্ছে।’’

তাহলে জিতছে কে?

মাকড়ভুলার রাস্তায় কাঠের বোঝা মাথায় মঙ্গলি শবর চোখ কুঁচকে বললেন, ‘‘উটা সময়ই বলবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন