দক্ষিণের কড়চা

বসন্ত রঙের আটপৌরে একটা লেফাফা—‘ছাড়তে তোকে চায় না তো মন, তুই যে মোদের কলজে ছেঁড়া ধন, চোখের জলে বুক ভেসে যায়, মন উচাটন, প্রাণ করে হায় হায়।’ কে কবে হৃদয় খুঁজে লিখেছেন, কেউ জানে না। গ্রামীণ বইমেলার টেবিলে দুর্বল বানানের কোনও পত্রিকাতেও ছাপানো হরফ দেখেনি এই সব আদুরে পদ্য। এখন আর দেখাও য়ায় না তাদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৭
Share:

হারানো পদ্যের খোঁজে

Advertisement

বসন্ত রঙের আটপৌরে একটা লেফাফা—‘ছাড়তে তোকে চায় না তো মন, তুই যে মোদের কলজে ছেঁড়া ধন, চোখের জলে বুক ভেসে যায়, মন উচাটন, প্রাণ করে হায় হায়।’ কে কবে হৃদয় খুঁজে লিখেছেন, কেউ জানে না। গ্রামীণ বইমেলার টেবিলে দুর্বল বানানের কোনও পত্রিকাতেও ছাপানো হরফ দেখেনি এই সব আদুরে পদ্য। এখন আর দেখাও য়ায় না তাদের। গেল কোথায় তারা? মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কষ্ট—তাঁদের মন খারাপের অক্ষর সাজিয়ে লিখে ফেলা সেই সব পদ্য সময়ের হাত ধরে উড়ে যেত বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামে। মানুষ যাকে চিনতেন, ‘বিয়ের পদ্য’। হারানো সেই পদ্যের খোঁজে নেমেছে বীরভূমের লাভপুরের একটি সংগঠন, ‘বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী’।

সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন ১১৪ জন সদস্য। পদ্য ফেরাতে এখন থেকে নিজেদের বিয়েতে বিয়ের পদ্য ব্যবহার করবেন তাঁরা—এমনই ইচ্ছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নানুরে একটি ছাপাখানা চালাচ্ছেন স্বপন চৌধুরী। বলছেন, ‘‘বছর কুড়ি আগেও গ্রামের বিয়েতে এমন পদ্য আকছাড়া লেখা হত।’’ পুরনো পান্ডুলিপি ঘেঁটে মনে করতে পারছেন তিনি, ‘আমি যাব ছাইকেলে (সাইকেলে) তুমি যাবে হেঁটে, তোমায় আমায় দেখা হবে, সিনিমার (সিনেমা) গেটে’। বলছেন, ‘‘বিশ বছর আগেও এ পদ্যও ছেপেছি। তবে সে বিশ-পঁচিশ বছরে মানুষের মনটাই বদলে গিয়েছে। আর এমন সব পদ্য ছেপে পেট চালাত যাঁরা, আমাদের মত সেই সব ছোট ছাপাখানাগুল একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ ভিয়েনের বদলে কেটারিং, হ্যাজাকের জায়গায় হ্যালোজেন— গ্রামের পুরনো মানুষেরা জানাচ্ছেন, আসলে গ্রামের মনটাই শহুরে হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন

দিল্লি, ঢাকা, কলকাতার পরে এবারের আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল জাপানের টোকিও শহরে। ১২-১৩ ডিসেম্বর, বাংলা ভাষা-ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে প্রায় শতাধিক বিশিষ্ট অধ্যাপক, আলোচক যোগ দিয়েছিলেন এই সম্মেলনে। সম্মেলনের শুরুতে ভাষণ দেন পবিত্র সরকার। ছিলেন বাংলাদেশের আনিসুজ্জিমান, সেলিনা হোসেন, চিনা অধ্যাপক দং ইওচেন -সহ বিশিষ্টরা।

সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, অভিবাসী সাহিত্য নিয়ে আলোচক হিসাবে গিয়েছিলেন বোলপুর পূর্ণিদেবী মহিলা মহাবিদ্যালয়ের শাহনাজ বেগম। তাঁর অভিজ্ঞতায়, ‘বাংলার বাইরেও যে বাংলা ভাষা নিয়ে এত আগ্রহী মানুষ, এত চর্চা হচ্ছে, সেটা সম্মেলনে না গেলে জানতেই পারতাম না। বাংলাদেশ কেবল নয়, পাকিস্তান থেকেও প্রতিনিধি এসেছিলেন। আশ্চর্য হয়েছি, চিনের প্রতিনিধি খুব সুন্দর করে বাংলা বলছেন। ২০১৯-এ চিনে বসবে এই সম্মেলনর আসর!’ এ বারের সম্মেলনে ঠিক হয়েছে, সংস্থার তরফে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করা হবে। একটি স্ট্যান্ডার্ড স্টাইল শিটও তৈরি করা হবে। তৈরি হচ্ছে আর্কাইভ।

নিবন্ধের কলম

পেশাগত ভাবে তিনি শিক্ষক। পাশাপাশি হাত পাকিয়েছেন নিবন্ধেও। মেদিনীপুর শহর থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে করছেন লেখালেখি। তিনি পিনাক বিজয় চক্রবর্তী। সম্প্রতি মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি হলে প্রকাশিত হল পিনাকবাবুর নিবন্ধ সঙ্কলন ‘এককলমী’। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে ছিলেন, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অভিজিৎ গুহ। ‘লালবাতি জ্বালাবই’, ‘চেনেন ছেলেটাকে?’ ইত্যাদি প্রবন্ধে রাজনীতি ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়কে এক সুতোয় গাঁথতে চেয়েছেন পিনাকবাবু। আর সেই বুনোটে সূত্র হিসেবে কাজ করেছে লেখকের সমাজ-জিজ্ঞাসা। বই প্রকাশের পাশাপাশি সমাজ ও সংবাদপত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক কোন জায়গায়, তা নিয়ে বসে আলোচনার আসর।

শুধু এক কবি

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য কবিতার অলি-অন্দর ছুঁয়ে। শক্তির চিঠি নিয়েই একদিন তাঁর কাছে হাজির হয়েছিলেন অ্যালেন গিনসবার্গ। পিটার অর্লিভস্কি আর গিনসবার্গের বীরভূম ভ্রমণের সময় তিনিই ছিলেন সঙ্গী। ১৩ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক বসুমতী’-র পাতায়। তিনি পঞ্চাশের দশকের কবি মনুজেশ মিত্র। অন্তরের গভীরে তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘...এক বিশাল, বিশাল কবিতা লেখা আছে সবখানে,/ আমি তাই পাঠ করি/ তার ছন্দে আমার মন দোলে-/ মনে হয় কবিতার মধ্য দিয়েই/ একদিন সেরে উঠবো।’

মনুজেশের জন্ম বীরভূমের সিউড়ি শহরে। ১৯৫৮ সালে বোলপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় পাঠানো তাঁর একটি কবিতার ছন্দকে ঘিরে কবির সঙ্গে সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যর তুমুল চিঠি চালাচালি হয়। মিশ্রবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার বেশি তাঁর কবিতায়, আত্ম-সমীক্ষণে। ‘দেশ’, ‘কৃত্তিবাস’-সহ বহু পত্রিকায় লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আমি অমল আঁধারে’(১৯৬৫), ‘কেন প্রতিধ্বনি’(১৯৭৭), ‘পাতারা কোথায় যায়’(১৯৯৬), ‘এই পুরাতন হৃদয় আমার’(২০০৫), ‘আবৃত্তি, তোমার জন্য’(২০০৬) এবং ‘কবিতা সঞ্চয়’(২০১৪)। বোলপুরের মলয় ঘোষ সম্পাদিত ‘ইলোরা’ পত্রিকা তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ২০০৯ সালে। তাঁকে নিয়ে ‘শুধু এক কবি’ নামে একটি তথ্যচিত্রও করে এই পত্রিকা। ৩১ ডিসেম্বর চলে গেলেন মনুজেশ।

সাঁওতাল পাড়ার নন্দিনী

শিলংয়ের পাহাড়ে বসেই ‘রক্তকরবী’র প্রথম খসড়া লেখেন রবীন্দ্রনাথ। নায়িকার নাম তখন ‘খঞ্জনী’। পাণ্ডুলিপি বদলাতে বদলাতে এক দিন ‘খঞ্জনী’ই হল নন্দিনী। সেই ‘নন্দিনী’-র চরিত্রেই অভিনয় করল ইলামবাজারের কামারপাড়া গ্রামের স্বভাবশান্ত আদিবাসী মেয়ে লক্ষ্মী কিস্কু।

সম্প্রতি বীরভূমের ইলামবাজারের দ্বারোন্দায় ‘আদিবিম্ব’র মঞ্চে সাঁওতালি ভাষায় ‘রক্তকরবী’ অবলম্বনে ১৭ জন সাঁওতাল ছেলেমেয়ে অভিনীয় করল নাটক ‘আরা বাহা’। সেখানেই নন্দিনী চরিত্রটিতে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছে লক্ষ্মী। কেন না, সমাজ-ব্যবস্থার জাঁতাকলের বিরুদ্ধে শান্ত নন্দিনীর প্রায় নিঃশব্দ লড়াই ‘আরা বাহা’তে তাঁর নিজেরও। লক্ষ্মী কখনও ‘রক্তকরবী’ পড়েনি। শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখেনি বিশ্বভারতীর কোনও রবীন্দ্র-নৃত্যানুষ্ঠানও। নাটকের পরিচালক ও শিল্প-নির্দেশক পার্থ গুপ্তর মুখে গল্প শুনেই সেই অর্থে ‘নন্দিনী’ চরিত্রে তাঁর প্রথম অভিনয়। ‘‘জানেন, বিশুপাগলের ওই গানটা এখনও কানে বেজে চলেছে, ‘আমেএম জতেৎ কিডিং আ/ ইঞ সুখ ইঞ য়াম কেদা (ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার)’। জানি না, কী করে কী হল। এত দিন কেবল নাচতাম। এখন মনে হচ্ছে অভিনয়টাও চালিয়ে যেতে পারব,’’—বলছেন বোলপুরের পূর্ণিদেবী কলেজের স্নাতকের ছাত্রী লক্ষ্মী। নাটকে তাঁর মুখে সংলাপ শুনে বিস্মিত এলাকাবাসীও। হতবাক বাবা সনাতন কিস্কু! ‘‘ও তো বাড়িতে কখনও কথাই বলে না। এত চুপচাপ মেয়ের মুখে কী করে মঞ্চে কথা ফুটল!’’ সনাতনবাবু সামান্য চাষের কাজ করেন, কখনও রাজমিস্ত্রিরও। শালের জঙ্গল ঘেরা মাটির ঘর। দাদা অলচিকি স্ক্রিপ্ট শেখায়, সাঁওতাল পরবে মাদল বাজায়। এই নিয়েই লক্ষ্মীদের ঘরকন্না।

কী করে সম্ভব হল এমন নাট্য-নির্মাণ? পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এলাকার দশ বারো জন মেয়েকে নিয়ে দু’দিনের ওয়ার্কশপ করি। সেখান থেকেই লক্ষ্মীকে বেছে নেওয়া। গানগুলো ওদের বাহা-সোহরাইয়ের সুরে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ব্যবহার করেছি কেবল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন