সেই ‘বুড়ো’ই খুনি!

সামনেই স্কুলের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। আমন্ত্রণ যাবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন পড়ুয়াদের কাছে। একটি আমন্ত্রণ পাঠানোর কথা ছিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় (ইউসিএলএ) গবেষণারত প্রাক্তনীর কাছেও। কিন্তু সে সুযোগ আর রইল না।

Advertisement

সুব্রত সীট

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০১:১৬
Share:

১। দুর্গাপুরের বিধাননগরের সরকারি আবাসনের এই কোয়ার্টারেই এক সময়ে থাকতেন মৈনাকেরা। ২। ছেলেবেলায় আবাসনের বন্ধু সুমনের সঙ্গে এই ঘরেই পড়াশোনা করতেন মৈনাক। ৩। দুর্গাপুরে মৈনাকের স্কুলের সামনে পুলিশের গাড়ি। যদিও স্কুল থেকে তেমন তথ্য মেলেনি। ছবি: বিকাশ মশান।

সামনেই স্কুলের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। আমন্ত্রণ যাবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন পড়ুয়াদের কাছে। একটি আমন্ত্রণ পাঠানোর কথা ছিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় (ইউসিএলএ) গবেষণারত প্রাক্তনীর কাছেও। কিন্তু সে সুযোগ আর রইল না।

Advertisement

দুর্গাপুরের বিধাননগরের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ওই প্রাক্তন ছাত্র মৈনাক সরকার বুধবার ইউসিএলএ-র এক অধ্যাপক ও নিজের স্ত্রীকে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া মারফত সেই খবর জেনে হতচকিত হয়ে পড়েন মৈনাকের এক সময়ের প্রতিবেশী ও সহপাঠীরা। তাঁরা যে মৈনাককে চিনতেন, সে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, বিশ্বাস করতে পারছিলেন না অনেকেই।

এক বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে দুর্গাপুরে এসেছিলেন মৈনাকের বাবা সত্যেন সরকার। স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে থাকতেন বিধাননগরে সরকারি আবাসনের তিন কামরার কোয়ার্টারে। প্রতিবেশীরা জানান, সত্যেনবাবুর মেয়ে শহরের স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান। মৈনাক ওই বেসরকারি স্কুল থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পরে বিধানচন্দ্র ইনস্টিটিউট ফর বয়েজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তার পরে খড়গপুর আইআইটি-তে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পান।

Advertisement

ওই আবাসনের একতলার কোয়ার্টারে থাকেন কমলেন্দু মাইতি। তিনি জানান, ছেলেমেয়ে বাইরে পড়তে চলে যাওয়ার পরে ২০০০ সাল নাগাদ সস্ত্রীক সত্যেনবাবু দুর্গাপুর ছাড়েন। তাঁরা কলকাতার কোনও বৃদ্ধাশ্রমে যান বলে জেনেছিলেন কমলেন্দুবাবুরা। কিছু দিন পরে সত্যেনবাবুর স্ত্রী মারা যান বলেও খবর পেয়েছিলেন। ২০০৪ সাল নাগাদ দুর্গাপুরের কোয়ার্টারটি ছেড়ে দেন সত্যেনবাবু। তার পর থেকে পরিবারটির সঙ্গে এই শহরের আর তেমন যোগাযোগ ছিল না।

কমলেন্দুবাবুর ছেলে ঝন্টু মৈনাকের থেকে বছর দুয়েকের ছোট। তিনি জানান, মৈনাককে বুড়ো ও তাঁর দিদিকে বুড়ি নামেই চিনতেন আবাসনের সকলে। সামনের ছোট মাঠে মৈনাকের সঙ্গে বল নিয়ে খেলতেন তিনি। ঝন্টুর কথায়, ‘‘বয়সে একটু বড় হলেও নাম ধরেই ডাকতাম বুড়োকে। এক সঙ্গে কত খেলেছি। শান্তশিষ্ট ছেলেটা কী করে এমন কাজ করতে পারে, বিশ্বাস হচ্ছে না!’’ তাঁর মা পূর্ণিমাদেবী বলেন, ‘‘বাড়িতে খুব একটা আসত না। তবে ভাল সম্পর্ক ছিল। সকালে পুণে থেকে বড় ছেলে খবরটা জানানোর পরে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি!’’

এখন মৈনাকদের সেই কোয়ার্টারটিতে পরিবার নিয়ে থাকেন উৎপল মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনও মৈনাককে দেখিনি। তবে এই কোয়ার্টার কেনার পরে দেখি, বাথরুমের দেওয়ালে, ফেলে রেখে যাওয়া বিছানার চাদরে অঙ্ক কষে রাখা। শুনেছি, সে সব নাকি মৈনাকেরই কীর্তি!’’ তাঁর স্ত্রী চম্পাদেবী বলেন, ‘‘ওকে দেখিনি ঠিকই। কিন্তু ঘটনাটা শোনার পর থেকে খুব কষ্ট হচ্ছে।’’ ওই আবাসনের উপরের তলায় থাকেন মৈনাকের এক সময়ের সহপাঠী সুমন সরকার। তাঁর মা হেনাদেবী বলেন, ‘‘আমার ছেলের স্টাডিরুমে দু’জনে এক সঙ্গে পড়াশোনা করত। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়েও আসত আমাদের বাড়িতে। ভাবতেই পারছি না, সে এমন কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল!’’ আর এক সহপাঠী, এখন গয়নার দোকানের মালিক মিঠুন পবি বলেন, ‘‘ক্লাস টেন পর্যন্ত এক সঙ্গে পড়েছি। মৈনাক তো শান্ত স্বভাবের ছিল। ও কী ভাবে এমনটা করতে পারে, মাথায় ঢুকছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে শুনে।’’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেঙ্গালুরুতে কর্মরত আর এক সহপাঠী বলেন, ‘‘নরম মনের ছেলে ছিল ও। শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকত।’’

বিধাননগরের ওই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক গৌতম বিশ্বাস জানান, মৈনাক প্রাণোচ্ছ্বল ছেলে ছিল। তবে কোনও অস্বাভাবিকত্ব কখনও তাঁদের নজরে পড়েনি। তিনি বলেন, ‘‘বুঝতে পারছি না কী করে এটা হল। আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। পড়াশোনা নিয়ে কোনও সমস্যা হলে আমার কাছে আসত। আইআইটি-তে সুযোগ পাওয়ার সময়ে শেষ যোগাযোগ হয়। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম।’’

ওই স্কুলে ২৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন সুমিতা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘মৈনাক ভাল ছেলে ছিল। এমন ঘটনা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।’’ কী পরিস্থিতিতে এই কাণ্ড ঘটালেন মৈনাক, তা এত দূর থেকে বোঝা মুশকিল বলেও মনে করেন তিনি। কিছু দিন আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে স্কুলের প্রাক্তনীদের গ্রুপে মৈনাককে দেখেছেন জানিয়ে সুমিতাদেবী বলেন, ‘‘স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তনীদের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু মৈনাকের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ তো আর নেই।’’

বিধাননগরের যে বেসরকারি স্কুলে মৈনাক পড়তেন, শুক্রবার সকালে দুর্গাপুরের নিউটাউশিপ থানার পুলিশ সেখানে যায়। তবে স্কুলের তরফে জানানো হয়, কোনও তথ্য দেওয়ার জন্য সময় লাগবে। থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার কথা জানার পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তারা খোঁজ নিতে গিয়েছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন