চাপা অসন্তোষ ছিলই। এ বার সম্মুখসমরের চেহারা নিল রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী দ্বন্দ্ব।
উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজনার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। নবান্ন সূত্রের খবর, দু’জনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। কথা কাটাকাটি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, একটা সময়ে ফোন কেটে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই সাংবাদিক বৈঠকে এসে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। মমতা বলেন ‘‘রাজ্যপালকে আমি বলেছি, আপনি এ ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। রাজ্যপাল কথা বলছেন, যেন মনে হচ্ছে বিজেপির ব্লক সভাপতি কথা বলছেন। কেন এটা হবে? আমরা কেউ চাকরবাকর নই।’’
এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যপাল অপমান করার পরে ভেবেছিলাম ছেড়েই দেব। এত অপমানিত জীবনে হইনি। উনি আমাকে ফোন করে হুমকি দিয়েছেন।’’
মমতা প্রকাশ্যে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলার পরে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজ্যপালও। সন্ধ্যায় রাজভবন থেকে দেওয়া এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যে ভঙ্গিমায় ও যে ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেছেন, রাজ্যপাল তাতে বিস্মিত। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে কথা একান্ত গোপনীয়। রাজ্যপালের বিশ্বাস ছিল, দু’পক্ষের মধ্যে যা কথা হয়েছে, তা কেউই প্রকাশ করবেন না। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী অপমানিত বোধ করতে পারেন এমন কোনও কথা দু’পক্ষের মধ্যে হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকিও দেওয়া হয়নি।’
বিভিন্ন ঘটনায় এর আগেও রাজ্যপালের সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছে রাজ্য সরকারের। বিভিন্ন টোল প্লাজায় সেনার সমীক্ষা নিয়ে রাজভবন এবং নবান্নের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছিল। রাজ্যপাল বলেছিলেন, সেনাকে অপমান করা উচিত নয়। তার পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্যপাল বিজেপির হয়ে কাজ করছেন। আর এ দিন মুখ খুললেন মমতা নিজে। এবং যে ভাবে রাজ্যপালকে আক্রমণ করলেন তিনি, তা কার্যত নজিরবিহীন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘উনি আমাকে আইনশৃঙ্খলা দেখাচ্ছেন। উনি কেন একটা পক্ষ নেবেন? আজকে যে কোনও একটা ছোট ঘটনা ঘটছে, বিজেপির লোকেরা কাগজ দিয়ে আসছে। আর উনি যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াচ্ছেন।’’
আরও পড়ুন:‘আমার কাছে সব গোষ্ঠীই সমান’
নোটবন্দি থেকে জিএসটি, সারদা থেকে নারদা— একের পর এক ঘটনায় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সঙ্গে মমতার সংঘাত লেগেই রয়েছে। বসিরহাটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যপালের সঙ্গে চাপানউতোরে সেই সংঘাতের বাতাবরণই আরও তীব্র হলো বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, মমতা মনে করেন বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের উস্কানিতেই এ রাজ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাই এ দিন রাজ্যপালের পাশাপাশি পরোক্ষে প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘দেশটাকে ভেঙে দিয়ে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে আগুন লাগিয়ে বাইরে গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন। বিদেশের ঐক্য চায় আর দেশের মধ্যে আগুন চায়। এটার ইতি হওয়া উচিত। আমাদের মতো লোকেরা এ সব সহ্য করবে না।’’
বসিরহাটে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত দুই পক্ষকেও এ দিন আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, দু’পক্ষের কিছু নেতা টাকার বিনিময়ে সংঘর্ষে উস্কানি দিচ্ছে। সেই নেতাদের সতর্ক করে মমতা বলেন, ‘‘আপনাদের জন্য আমাকে অনেক অসম্মানিত হতে হয়েছে। আজ রাজ্যপাল আমাকে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। তাতে খুবই অসম্মানিত হয়েছি। আমি রাজ্যপালের দয়ায় ক্ষমতায় আসিনি। মানুষের ভোটে ক্ষমতায় এসেছি। মানুষ যে দিন চাইবেন না চলে যাব। আমি কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্ব করার জন্য এই চেয়ারে বসিনি। আমার চেয়ার ছেড়ে দিতে এক সেকেন্ড লাগবে না।’’
রাজভবনের বিবৃতিতে পাল্টা বলা হয়েছে, রাজ্যের প্রধান হিসেবে রাজ্যপাল সমাজের বিশেষ কোনও দল বা সম্প্রদায়ের নন, রাজ্যের সব নাগরিকের অভিভাবক। সমাজের কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর কাছে গুরুতর অভিযোগ করেন বা রাজ্যে যদি কোনও গুরুতর ঘটনা ঘটে, তা হলে তা মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনাই রাজ্যপালের কাজ। তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপাল বলেছেন, যে কোনও উপায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মনে করছেন, রাজ্যপাল যে ভাবে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন, সেটা যথেষ্ট অপমানজনক। আর সে জন্য ত্রিপাঠীকে সতর্ক করে মমতার বক্তব্য, ‘‘মাননীয় রাজ্যপালের কাছে আমার আবেদন, আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন না। এটা খুবই অপমানকর। আমি খুব ছোটবেলা থেকে সক্রিয় রাজনীতি করছি। সারা জীবন ফেলে এসেছি এটা করতে করতে। আজ এখানে এসে আমাকে অসম্মানের কথা শুনতে হবে? তবে যদি এর জন্য আমি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, আমি সত্যিই দুঃখিত।’’