ফেরার পথে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
লন্ডন সফর কাটছাঁট করে আজই ফিরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে ঘূর্ণিঝড়-বর্ষণ-বন্যা ইত্যাদির খবর পেয়ে দু’ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফেরার সব রকম বন্দোবস্ত করিয়ে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘যে ধরনের দুর্যোগের আশঙ্কা আছে বলে খবর পাচ্ছি, তাতে আমার ফিরে গিয়ে মানুষের পাশে থাকাটাই সব থেকে জরুরি। তাই কালবিলম্ব করতে চাই না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আরও যাঁরা ফিরছেন, তাঁদের সকলের টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলা হয় তড়িঘড়ি।
আজ স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টায় হিথরো বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানে চড়বেন মুখ্যমন্ত্রী। কাল সকালে দিল্লিতে নেমে বিকেলের মধ্যেই কলকাতা।
প্রথম যখন তাঁর লন্ডনের সফরসূচি ঠিক হয় তখন স্থির হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী ২৬ জুলাই রাতে পৌঁছে ৩১ জুলাই রাতে লন্ডন ছাড়বেন। পরে তা বদলে স্থির হয়, তিনি ৩০ জুলাই রাতের উড়ান ধরবেন। কিন্তু ঝড়ের বেগে সেই সফরসূচিতেও বদল ঘটাল ঝড়-বৃষ্টির খবর।
দেশ ছাড়ার আগে থেকেই মমতা আবহাওয়ার খোঁজখবর রাখছিলেন। রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির লক্ষণ দেখে স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে বিপর্যয় মোকাবিলা কমিটিও গড়ে দিয়ে এসেছিলেন। লন্ডনে পৌঁছেও সেই যোগাযোগ অবিরাম চলেছে। তবু, ঝড়-বৃষ্টি নাগাড়ে হচ্ছে বলে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে কেন ফিরে যেতে হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, আজকের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্ত খবর প্রতি মুহূর্তে তাঁর কাছে আসছে। তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এবং প্রশাসনেরও অনেক শীর্ষকর্তা রাজ্যে উপস্থিত রয়েছেন।
মমতার ব্যাখ্যা, ‘‘আমার কাছে রাজ্যের মানুষের স্বার্থ সবার আগে। তাই সেখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে জানলে আমি অন্য সব কিছু ভুলে যেতে প্রস্তুত।’’ মমতা নিজে এ কথা বললেও আপাত ভাবে এই সিদ্ধান্তের পিছনে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাঁদের অভিমত, রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বড় দুর্যোগ হলে এই লন্ডন সফর নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমনটা আঁচ করেই হয়তো তিনি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নিজের জমিতে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন। লন্ডনে তিনি তাঁর অসমাপ্ত সফরের বাকি সময়টুকুর জন্য রেখে যাচ্ছেন অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং কয়েক জন আমলাকে। বলেছেন, ‘‘শেষ দিনের যেটুকু যা আছে, ওঁরা সেগুলি সম্পূর্ণ করবেন।’’ সাধারণ ভাবে তাঁর লন্ডন সফরে উল্লেখযোগ্য কাজগুলি ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গিয়েছে। বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক এবং তাঁদের সম্মেলনে বক্তৃতা যার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজ ফেরার আগে মমতা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। তা হল, এশিয়া হাউসে গোলটেবিল বৈঠক। ওয়েস্টমিনস্টার-এ নিউ ক্যাভেন্ডিস স্ট্রিটে এই এশিয়া হাউস। সেখানে বাছাই করা রাষ্ট্রনেতা, মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট জনেরা আমন্ত্রিত হন। বৈঠকের জন্য যিনি আমন্ত্রিত এবং যে কতিপয় ব্যক্তি বৈঠক কক্ষে থাকার অধিকারী তাঁরা ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার তো নেই-ই, এমনকী, বৈঠকে আলোচিত প্রসঙ্গ ও প্রশ্নোত্তর ঘরের বাইরে আসাটাও এখানকার নিয়মবহির্ভূত। সব কিছুই হবে ‘ইন ক্যামেরা’। গোলটেবিলে বসার আয়োজন ছিল ১৬ জনের। কিন্তু বেনজির ভাবে সেই সংখ্যা ২০-তে পৌঁছে যায়। উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, বিভিন্ন বিদেশি ব্যাঙ্ক, কেপিএমজি প্রভৃতি বিদেশি সংস্থার শীর্ষকর্তারা।
প্রশ্নোত্তর পর্বে অনিবার্য ভাবে আসে জমি প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, ‘‘লাঠি মেরে জমি আমি নেব না। আপনাদের নির্দিষ্ট কী দরকার বলুন। কেস টু কেস ভিত্তিতে ব্যবস্থা হবে।’’ প্রশ্ন আসে, সরকারের নিচুতলায় কাজের অসুবিধা নিয়েও। অনেকে বলেন, উঁচুতলায় যে তৎপরতা দেখানো হয় নিচুতলায় তা হয় না। মমতা বলেন, ‘‘আমরা এই ধরনের পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’’ কেন্দ্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও জানতে চান কেউ কেউ। তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিভিন্ন বিষয়ে যেমন আমাদের মধ্যে মতভেদ আছে, তেমনই অনেক বিষয়ে আমরা কেন্দ্রের পাশে দাঁড়াই। যেমন, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি, জিএসটি। এ সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধিতা নেই।’’ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে ঘণ্টাখানেক।
পরে বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রীকে বিদায় জানাতে এসে ব্রিটেনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রঞ্জন মাথাই জানান, ইন্ডিয়া হাউসের বৈঠক এ দেশে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ফোন পেয়েছেন তিনি। সকলেই পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
ইন্ডিয়া হাউসের বৈঠকের পরে মমতা যান স্বরাজ পলের বাড়িতে। কাল মমতার সঙ্গে দেখা করতে এসে স্বরাজ পল মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আজ কর্ণ বিলমোরিয়া ও অনিল অগ্রবাল-সহ বেশ কয়েক জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিল্পপতি ছিলেন। স্বরাজ পলের চা-চক্রে ফের জমি প্রসঙ্গ ওঠে। স্বরাজ জানান, সিঙ্গুরে তিনি জমি কিনেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেখানে শিল্প হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। তাই নতুন করে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে চাই।’’ স্বরাজ পলের বাড়ি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী সোজা চলে যান হিথরোয়।
এ যাত্রা অবশ্য মমতার সঙ্গে দেখা হল না হিন্দুজা ভাই বা লক্ষ্মী মিত্তলের। হিন্দুজা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। গত কাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সময় বার করা যায়নি। হিন্দুজা আবার গত রাতেই বাইরে চলে গিয়েছেন। আর মিত্তল? মমতার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সম্ভাবনাকেও দূরে ঠেলে সরিয়ে দিল পশ্চিমবঙ্গের ঘূর্ণিঝড়। যদি ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী মমতা কাল পর্যন্ত লন্ডনে থাকতেন, তা হলে মমতা-মিত্তল বৈঠক অসম্ভব ছিল না।
নিয়ম করে হাঁটার সময় অবশ্য এ দিনও বের করে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। হাঁটতে হাঁটতে এ দিন গিয়েছিলেন হাইড পার্কের দিকে। ফুটপাথে রোমানিয়া থেকে আসা এক পথিকশিল্পী পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন বাজাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে বাজনা শোনেন মমতা। শিল্পী জানতে চান, ‘‘আপনি কোন দেশের?’’ ভারতের লোক জেনে সুর তোলেন ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি।’ মমতা তখন এগিয়ে গিয়ে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানটা চেয়ে নিয়ে বাজিয়ে দেন ‘সারে জঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা...’-র দু’কলি।