‘কে ভাই প্রধানমন্ত্রী? এক বার ভোটে জিতেই এত দম্ভ, এত অহঙ্কার!’

একাধিক প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের জন্য বছরখানেক ধরেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ফুঁসছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়েও ক্ষোভ ছিল দিল্লির ওপর। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর সেই রাগ-ক্ষোভ-অভিমান শনি-দুপুরে হঠাৎই পঞ্চমে চড়ে গেল!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:২৪
Share:

নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার।—নিজস্ব চিত্র

একাধিক প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের জন্য বছরখানেক ধরেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ফুঁসছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়েও ক্ষোভ ছিল দিল্লির ওপর। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর সেই রাগ-ক্ষোভ-অভিমান শনি-দুপুরে হঠাৎই পঞ্চমে চড়ে গেল! এতটাই যে, দিল্লিকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি পর্যন্ত দিতে ছাড়লেন না মমতা! এমনকী প্রধানমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে এ-ও বললেন, ‘‘কে ভাই পিএম? এক বার ভোটে জিতেই এত দম্ভ, এত অহঙ্কার!’’

Advertisement

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এত ক্ষোভ কেন?

নেপথ্যে একাধিক কারণ। অনুঘটকের কাজ করেছে নীতি আয়োগের পাঠানো একটি চিঠি। এ দিনই দুপুরে দিল্লি থেকে সেটি এসে পৌঁছেছে নবান্নে। তাতে বলা হয়েছে, ৬৬টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে এক ছাতার তলায় এনে ২৮টি প্রকল্প করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টিকে ‘কোর’ এবং ছ’টিকে ‘কোর অব দ্য কোর’ প্রকল্প বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি দু’টি ‘অপশনাল’। নীতি আয়োগের নির্দেশ, সব রাজ্যকে ২০টি কোর প্রকল্পের অংশীদার হতেই হবে। কেন্দ্রের বাতলে দেওয়া ওই প্রকল্পগুলিতে দিল্লি দেবে ৬০ শতাংশ টাকা। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা ঢালতে হবে রাজ্যকেই।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর মূল আপত্তি এখানেই। মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠির সার কথা তাঁকে জানাতেই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা। বলেন, ‘‘ওঁরা ভেবেছেটা কী! যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ধারপাশ দিয়েও যাচ্ছে না! স্রেফ নিজেদের স্বার্থে যে ভাবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের খরচের দায় রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং তা বইতে বাধ্য করছে, সেটা রাষ্ট্রপতি শাসনেরই নামান্তর।’’

সোমবার তিন দিনের জন্য রাজ্যে আসছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানান, দিল্লির এই ‘ঔদ্ধত্য ও স্বৈরাচারের’ বিরুদ্ধে রবিবারই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বিহিত চাইবেন। দিল্লির ‘দাদাগিরি’র বিরুদ্ধে নীতীশ কুমার-অখিলেশ সিংহদের মতো আঞ্চলিক নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে আগামী দিনে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়েরও ইঙ্গিত দেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যত দূর শুনেছি, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে কড়া চিঠি দিয়েছেন। আমি সেটাও জোগাড়ের চেষ্টা করছি।’’

ঘটনা হল, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বেশ কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দিল্লি বরাদ্দ ছাঁটাই করার পর থেকেই মমতা চটে রয়েছেন। নীতি আয়োগের পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে মুখ্যমন্ত্রীর সেই পুরনো ক্ষোভ এ দিন ফের বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘‘একে তো কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। তার উপর প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজ্যের স্বাধীনতাও কেড়ে নিচ্ছে!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যই যদি যদি টাকা ঢালবে, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর নামে প্রকল্প করবে কেন? এ রাজ্যে মণীষীর তো অভাব নেই। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নজরুলের মতো মণীষীরা ছিলেন। তাঁদের নামেই প্রকল্প হবে।’’ এই যুক্তিতে এরই মধ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’র নাম পরিবর্তন করে ‘রাজ্য গ্রাম সড়ক যোজনা’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কেন না ওই প্রকল্পে আগে রাজ্যকে ১০ শতাংশ টাকা দিতে হতো। এখন ৪০ শতাংশ টাকা দিতে হয়।

মমতার এই ঝাঁঝালো সমালোচনা নিয়ে অবশ্য সরকারি ভাবে কেন্দ্র এ দিন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর এই রাগ অমূলক। কারণ, রাজ্যগুলির দাবি মেনেই চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কর থেকে আদায়কৃত অর্থে রাজ্যের ভাগ ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করেছে কেন্দ্র। রাজ্যগুলির বক্তব্য ছিল, প্রকল্প রূপায়ণে তাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত। কেন্দ্র সেটাই করেছে। প্রকল্প রূপায়ণে নিজেদের দায়বদ্ধতা কমিয়ে রাজ্যকে আরও বেশি অর্থ ও স্বাধীনতা দিয়েছে। ওই কর্তার বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার গাছেরটা খাওয়ার পাশাপাশি তলারও কুড়োতে চায়। কারণ, তারা নিজেদের রাজস্ব আদায় কোনও ভাবেই বাড়াতে পারছে না। এ বারের রাজ্য বাজেট দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যাবে। তার থেকেও বড় কথা হল, বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ কেন্দ্রের অনুদানও নিজেদের বাজেটে সামিল করে নিয়েছে মমতা-সরকার!

অর্থ মন্ত্রকের আর এক আমলার কথায়, ‘‘সমস্যা হল, কেন্দ্রীয় করে রাজ্যের ভাগ বাড়ানোর পর পশ্চিমবঙ্গ এখন যে বর্ধিত টাকা পাচ্ছে, তার বেশির ভাগটাই খয়রাতিতে চলে যাচ্ছে! পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে টাকা থাকছে না।’’ ওই আমলার বক্তব্য, নীতি আয়োগের চিঠির পর মমতা-সরকারকে এখন বাধ্যতামূলক ভাবেই কুড়িটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে ৪০ শতাংশ অর্থ ঢালতে হবে। কিন্তু সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? হতে পারে, সেই কারণেই চিন্তায় মুখ্যমন্ত্রী।

দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর গত দু’মাসে বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্র বিরোধিতায় সরব হয়েছেন মমতা। আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করা নিয়ে কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। আন্তঃরাজ্য কমিশনের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের অভিযোগে কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। আবার রাজ্যকে না জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের নতুন আট আইএএস অফিসারকে কেন্দ্র বিভিন্ন মন্ত্রকে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগ করায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ দিন নীতি আয়োগের চিঠি নিয়ে ক্ষোভ জানানোর প্রসঙ্গে সেই বিষয়গুলিও তোলেন মুখ্যমন্ত্রী।

অতীতে বাম জমানায় অভিযোগ উঠেছিল, নিজেদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগে সরব তারা। এখন মমতার সরকারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। তৃণমূল অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বিরূপ মনোভাব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

এ নিয়ে আগামী দিনে যে তিনি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চালাবেন, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছে তৃণমূলের সংসদীয় দল। ওই বৈঠকেও নীতি আয়োগের চিঠির বিষয় নিয়ে ক্ষোভ জানানো হতে পারে।

মমতার প্রশ্ন-বাণ

উপভোক্তাদের টাকা বিলিতে আধার কার্ড বাধ্যতামূলক কেন?

বেঙ্গল ক্যাডারের আইএএস-দের দিল্লিতে প্রশিক্ষণ কোন যুক্তিতে?

কেন্দ্রের অফিসারদের রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে নজরদারি কেন?

রাজ্যের তিন লক্ষ কোটি ঋণের পুনর্গঠনে কেন্দ্র নীরব কেন?

সিবিআই, ইডি, আয়কর-কে দিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করা হচ্ছে কেন?

রাজ্য খরচের বড় অংশীদার হলেও প্রধানমন্ত্রীর নামে কেন প্রকল্প হবে?

কেন বন্ধ করা হচ্ছে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় প্রকল্প?

১০০ দিনের কাজ, গ্রামে পাকা রাস্তার টাকা কেন আটকে রাখা হয়েছে?

জিএসটি বিলে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত চলছে কেন?

রাজ্য কর্মীদের বর্ধিত বেতনের দায় কেন নেবে না কেন্দ্র?

কে ভাই পিএম? এক বার ভোটে জিতেই এত দম্ভ, এত অহঙ্কার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন