জনসমুদ্রে ভেসে। —নিজস্ব চিত্র।
বিপুল সমাগম। গোটা কলকাতা কার্যত অবরুদ্ধ। জেলা শহর, মফসসল, গাঁ-গঞ্জ উজিয়ে ধর্মতলায় লাখে লাখে লোক আনল তৃণমূল। সমাবেশ দেখে আপ্লুত নেত্রী মানুষের প্রতিই উৎসর্গ করলেন এ বারের শহিদ দিবস। আর দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে খুব স্পষ্ট করে বললেন, ‘‘আমি মানুষের বিরুদ্ধে কাউকে কোনও কাজ করতে দেব না।’’ শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বান, ‘‘এমন ভাবে কাজ করুন, এমন আত্মত্যাগ করুন, যাতে কেউ কোনও দিন আপনাকে বাংলার বুক থেকে সরাতে না পারে।’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ দিনের সমাবেশ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি সেই পুরনো তৃণমূল কর্মীদের চাই, যাঁরা গুলির সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন, রৌদ্রের মধ্যে লড়াই করেছেন, ঝড়ের মধ্যে লড়াই করেছেন। যাঁরা ভাঙেন, তবু মচকান না।’’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুরনো তৃণমূল কর্মীদের, অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার আগের তৃণমূল কর্মীদের ফেরত চেয়ে মমতা দলকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল আড়ে-বহরে দ্রুত বেড়েছে। বিভিন্ন দল ছেড়ে বানের জলের মতো লোকজন ঢুকেছে তৃণমূলে। পুরনো নেতা-কর্মীরা অনেক এলাকাতেই এই নবাগতদের চাপে পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন। দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বেড়েছে। নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি শুরু হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্যে তোলাবাজি, সিন্ডিকেট রাজ বেড়েছে। সে সব রুখতেই মমতা পুরনো তৃণমূল কর্মীদের গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তাঁর বার্তা, ‘‘আমরা লোকের থেকে টাকা তুলে দল চালাতে চাই না। দলের সদস্যদের টাকাতেই দল চালাতে চাই।’’ পুরনো তৃণমূল কর্মীদের প্রশংসা করে মমতার মন্তব্য: ‘‘আমি সেই কর্মীদের পাশি থাকি, যাঁরা দু’মুঠো ভাত খেয়ে থাকেন, ঘরে যা আছে তাই খেয়ে থাকেন, মণ্ডা-মিঠাই খাওয়ার জন্য লোভের ফাঁদে পা দেন না।’’ গত পাঁচ বছরে ব্লক থেকে রাজ্য পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল নেতাদের অনেককে ফুলেফেঁপে উঠতে দেখা গিয়েছে। মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে সব তাঁর নজর এড়ায়নি। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ থাকার চেষ্টা করুন। অসাধারণ হবেন না। অসাধারণ হতে গিয়ে লোভের ফাঁদে পা দেবেন না।’’
দলে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীর সংখ্যা খুব বেশি রয়েছে বলে অবশ্য মমতা মনে করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মনে রাখবেন, দু’-একটা লোক একটু-আধটু খারাপ কাজ করে, আর বদনাম হয় গোটা দলটার।’’ কর্মীদের প্রতি দলনেত্রীর পরামর্শ, ‘‘বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক কর্মী হতে না পারলে রাজনীতি করার কোনও অধিকার আমার নেই। নিজেদের এমন ভাবে তৈরি করুন, যাতে এক দিন রাস্তা দিয়ে আপনি হেঁটে গেলে লোকে গর্ব করে বলবে, দেখ দেখ, এক জন তৃণমূলকর্মী যাচ্ছেন। কত ভাল! আমি বিপদে পড়লে, ডাকতে হয় না, পাশে এসে দাঁড়িয়ে যান।’’
আরও পড়ুন: মন বদলে সুমন আবার মমতার মঞ্চে
তবে দলের কর্মীদের প্রশংসাও এ দিন শোনা গিয়েছে মমতার মুখে। তিনি বলেন, ‘‘এ বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যত কুৎসা হয়েছে, তা জীবনে কোনও দিন হয়নি। যত অত্যাচার হয়েছে, তা কখনও দেখিনি। তা সত্ত্বেও আমাদের কর্মীরা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই করেছেন, মাটি কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই দিয়েছেন।’’ তৃণমূলকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনও কুৎসা, অপপ্রচার বরদাস্ত করবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা। এরই পাশাপাশি কর্মীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ: ‘‘কোনও ঝগড়া-বিবাদে আমরা জড়াব না। পাড়ায় পাড়ায় পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে অনেক সময় গোলমাল হয়। সেই গোলমালকেও আমাদের নিজেদের গণ্ডগোল বলে চালানোর চেষ্টা হয়।’’ মমতার কথায়, ‘‘বিভেদ তৈরির চেষ্টা হবে। কিন্তু সে ফাঁদে পা দেবেন না। মনে রাখবেন, ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করা যাবে না। ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে দু’এক জন কাজ করেন। সবাই নয়। ব্যক্তির স্বার্থের আগে দলের স্বার্থ। ব্যক্তির স্বার্থের আগে মানুষের স্বার্থ।’’ সেই মানুষের স্বার্থে কাজ করার জন্য এ দিনের সমাবেশ থেকে বার বার আহ্বান জানিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘মানুষকে ভাল না বাসলে তৃণমূল কংগ্রেস থাকবে না। আর তৃণমূল কংগ্রেস না থাকলে আমরা কেউ থাকব না।’’