প্রথমবার পা রেখেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই প্রথম সরাসরি ছাত্র বিক্ষোভের আঁচ পেলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে পুলিশ নির্যাতনের অভিযোগ তুলে উপাচার্যকে ঘেরাও করেন একদল ছাত্রছাত্রী।
গত বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে নিজেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন মমতা। আর এ দিন প্রেসিডেন্সিতে মমতার আগমন ঘিরেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেধেছিল। মূলত ২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রেসিডেন্সিতে তৃণমূলীদের হামলার ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। প্রেসিডেন্সিতে যে মুখ্যমন্ত্রী স্বাগত নন সেই কথাই বলা ছিল পোস্টারে।
মমতা অবশ্য এ দিনের এই পোস্টার প্রদর্শন, স্লোগান, বিক্ষোভকে আমলই দেননি। ডিরোজিও হলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আমাকে এক জন নবান্নে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি প্রেসিডেন্সি যাচ্ছেন?’ আমি বললাম, কেন যাব না? কথা দিয়েছি। অফকোর্স যাব। যাদবপুরে যখন সমস্যা হয়েছিল, ওরা ডাকেনি আমি অনাহুত হয়েই দিয়েছি। আমি যাই যেখানে প্রয়োজন মনে করি।’’
এখানেই তিনি থামেননি। বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রে সব মতাবলম্বী থাকবে এটাই বাস্তব। তা বলে আমি এখানে কেন ঢুকবো তার কৈফিয়ত দিতে হবে না কি? এখানে ঢোকার জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হবে? আমি জোর করে কিছু করি না। এখানে ঢোকার জন্য যদি কারও অনুমতি লাগে সেটা একমাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রধানের। গণতন্ত্রে সৌজন্য বলে একটা কথা আছে। আমি যেমন সেটা মানি, অন্যদেরও মানতে হবে।’’
এর পরেই প্রেসিডেন্সির জন্য অনুদানের ঝাঁপি খুলে দেন মমতা। কী ছিল সেই ঝাঁপিতে? নিউটাউনে প্রেসিডেন্সির নতুন ক্যাম্পাসের জন্য ১১৮ কোটি (তার মধ্যে মঞ্চেই উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়ার হাতে দিলেন ৩০ কোটির চেক), বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরামতি, সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ণে ১০ কোটি, প্রেসিডেন্সির গ্রন্থাগারের উন্নতিকল্পে ১ কোটি ৭৮ লক্ষ, কার্সিয়াংয়ের ডাও হিলে ১০০ এর জমিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমালয়ান সেন্টার তৈরির জন্য ৩০ কোটি। এখানেই শেষ নয়। প্রেসিডেন্সির অনুষ্ঠানের পরে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে অন্য একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে ১ কোটি টাকা প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাগ (প্রত্যেককে ৫০ লক্ষ টাকা) করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রেসিডেন্সির আমান্ত্রণে তিনি যে আপ্লুত তা ডিরোজিও হলে মমতার বক্তৃতাতেই পরিষ্কার। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনাদের ঐতিহ্যময় ঘরানায় আসার সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা একটা বড় পাওনা। যে ভালবাসার আঁচল উপহার দিয়েছেন তা আমার মনে থাকবে।’’ পাল্টা অভিবাদনবার্তায় তার আগে অনুরাধাদেবীও বলেছেন, ‘‘এই প্রথম আমাদের এখানে পা রাখলেন, আমরা অভিভূত। আপনি শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, যুবাপ্রজন্ম ও সমাজের জন্য এক প্রেরণা।’’
পারস্পরিক প্রশংসা ও অভিনন্দনের বাতাবরণের অন্য পিঠে প্রেসিডেন্সি চত্বর এ দিন ছিল মমতা বিরোধী স্লোগান আর পোস্টারে উত্তাল। গাছের গুঁড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়-বড় হরফে সর্বত্র লেখা— ‘ইউ আর নট ওয়েলকাম সিএম। ২ এবং ১০ জুলাই মনে রেখো।’’ হাতে-হাতে হাততালি, পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে সেই পুরনো ‘হল্লা বোল’ আর ‘হোক হোক হোক কলরব’। অনুষ্ঠান শেষে মমতা যখন প্রেসিডেন্সির মাঠ পেরিয়ে হাঁটা লাগিয়েছেন তখন আন্দোলনকারী ওই ছাত্রছাত্রীরাই পুলিশের ধাক্কা খেতে-খেতে ব্যানার, পোস্টার, কালো কাপড় হাতে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে ছুটতে-ছুটতে স্লোগান দিয়েছেন— ‘‘ধিক্কার, ধিক্কার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, আর নেই দরকার।’’
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঢোকা মাত্র আওয়াজ ওঠে, ‘‘গান হোক, গান হোক।’’ সমস্বরে গান শুরু হয়, ‘‘দেখো ভাল জনে রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে.....।’’ মন্ত্রীর গাড়ি থেমে যায়। অপ্রস্তুত পুলিশ কী করবে ভেবে পায় না কয়েক মুহূর্ত। তার পর পোর্টিকোর ভিতর দিয়ে না গিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে গাড়ি ঢোকে।
কিন্তু মমতার গাড়ি ঢোকার সময় ঠিক বুঝতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা। বিষয়টি বুঝতে পেরেই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় ছাত্রদের। কয়েকটি পোস্টার ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে ছাত্ররা অভিযোগ জানাতে থাকে যে, পুলিশ তাঁদের গায়ে হাত তুলেছে। পুলিশের শাস্তির দাবিতে এ বার তাঁদের বিক্ষোভ অবস্থান শুরু হল বেকার হলের সামনে। উদ্বিগ্ন পুলিশ যখন মুখ্যমন্ত্রীকে কী ভাবে অনুষ্ঠানের শেষে প্রেসিডেন্সির বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় সেই জল্পনা করছেন এমন সময় মমতা অনুষ্ঠান সেরে বাইরে বেরিয়ে আসেন। জোরে হাঁটতে শুরু করেন প্রেসিডেন্সির মাঠ দিয়ে। মাঠ পার হয়ে প্রেসিডেন্সি চত্বর ছেড়ে হেঁটে হেঁটেই তিনি চলে যান কলেজ স্কোয়ারের অন্য দিকে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। মুখ্যমন্ত্রীর পরের অনুষ্ঠান ছিল সেখানেই।
প্রেসিডেন্সিতে তখন পড়ুয়ারা ঘেরাও করেছেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়াকে। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের উপর লাঠি চালিয়েছে। তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ঘরের দেওয়ালে স্লোগানেও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তুলে স্লোগান লেখা। পদত্যাগের প্রশ্নে অনুরাধাদেবী বলেন, ‘‘আমি সে দিনই পদত্যাগ করব যে দিন আমি ভুল করব। আমি কোনও ভুল করিনি তাই পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।’’
এর মধ্যেই প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এসে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের অনেক সদস্যই। উপাচার্যের পাশে বসা রেজিস্ট্রারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের। কেউ কেউ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে থাকেন। আজ, শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠান। সে কারণেই কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের অনুরোধ করেন ঘেরাও তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু পড়ুয়ারা ঘেরাও তুলে নিতে অস্বীকার করেন। চালিয়ে যাবেন বলেই জানান। উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া বলেন, ‘‘আমি উচ্চশিক্ষা দফতরকে অনুরোধ করব ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত করতে। যদি মারধরের ঘটনা ঘটে থাকে তা দুঃখজনক। তবে ভিড়ের মধ্যে যদি কিছু হয়ে থাকে সেটা তো আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।’’
প্রতক্ষ্যদর্শীরা অবশ্য জানিয়েছেন, পুলিশ লাঠি হাতে দৌড়াদৌড়ি করলেও, ছাত্রছাত্রীদের উপরে তারা লাঠি চালায়নি। এমন দাবি পুলিশেরও। নবান্ন সূত্রের খবর, যে ভাবে ছাত্রছাত্রীরা মমতা বেরিয়ে যাওয়ার পরে উপাচার্যকে ঘেরাও করে রেখেছেন তাতে রাজ্য সরকার ক্ষুব্ধ। ঘেরাও তুলতে উপাচার্য যে কোনও সাহায্য চাইলেই তা দেওয়া হবে বলেও অনুরাধাদেবীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে উপাচার্য পুলিশ ডাকতে চাননি। তিনি জানিয়ে দেন, ‘‘যতক্ষণ ঘেরাও চলবে আমি আমার চেয়ারেই বসে থাকব।’’
এ দিনের ছাত্র বিক্ষোভের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রেসিডেন্সির শিক্ষক এবং প্রাক্তনীরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত সংস্থা। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ কেন?’’ এক প্রাক্তনীর মন্তব্য, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকঠাক যাতে চলে তার জন্য রাজ্য সরকার মেন্টর উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়ে দিয়েছে। তাদের আর তো করার নেই।’’ বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই অবশ্য অভিযোগ, প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাও রাজ্য সরকার পুরনো প্রেসিডেন্সির শিক্ষকদের বদলি করে দিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে। আমাদের ক্ষোভ সেখানেই।’’
প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উচ্চ শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, তাঁরাও বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে খতিয়ে দেখছে। এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ তুলে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর্জি জানালেও, ছাত্রছাত্রীরা তাতে কর্ণপাত করেননি।