টার্গেট দিল্লি
দিল্লি সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সফরকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহও বেশ রঙিন। কবিগুরুর একটি পঙ্ক্তি খুব মনে পড়ছে— ‘...গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে... ’।
না, এ ক্ষেত্রে বার্তাটা শুধু গ্রামে গ্রামে নয়, রাজ্যে রাজ্যে রটে গিয়েছে।
বার্তাটা দেওয়া হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে, একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জাতীয় রাজনীতির সাগর সঙ্গমে পৌঁছতে চাইছেন, সে কথাটা তিনি নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেছিলেন। নিজেদের রাজনৈতিক ধাত্রীভূমি থেকে প্রতিটি আঞ্চলিক দল আরও বেশি শক্তি নিয়ে সংসদে পৌঁছক এবং বিজেপি-কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে উঠুক, সেই আহ্বান রেখেছিলেন। নিজেকে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড় থেকে সরিয়ে রাখছেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। সহযোগীদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন।
তার পর, দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে মঙ্গলবার থেকে মমতাকে ঘিরে রাজনীতির রামধনু এমন বলয় তৈরি করতে শুরু করেছে যে এ কথা বলতেই হচ্ছে, একুশের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া বিকল্প জোটের বার্তা রাজ্যে রাজ্যে রটে গিয়েছে, গোটা দেশে রটে গিয়েছে।
মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত উত্তর ও পূর্ব ভারতের সব আঞ্চলিক মহারথীরা মমতার ‘দরবারে’ সচেতন ভাবে হাজিরা দিয়ে গেলেন। দিল্লি-পঞ্জাবে ঝড় তোলা আম আদমি পার্টি বা উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি তো বটেই, জাতীয় রাজনীতিতে আপাত-অনীহা দেখানো ওড়িশার শাসক দল বিজেডি-ও মমতার দফতরে হাজিরা দিতে ভুলল না। কেজরীবাল, মুলায়ম, নবীন— সকলেই দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের পাঠালেন মমতা সংসদীয় দফতরে। আর কোনও এক কালে জাতীয় রাজনীতিতে মমতার ঘোর প্রতিপক্ষ বা কোনও কোনও ক্ষেত্রের পথের কাঁটা হিসেবে পরিচিত ছিলেন যিনি, বাংলার প্রতিবেশী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ সুপ্রিমো সেই নীতীশ কুমার তো নিজেই বৈঠক করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রথম দিনের এই ব্যস্ত কর্মসূচির ফাঁকে সময়ে কুলিয়ে উঠতে না পারায়, দ্বিতীয় রাতে নৈশাহার কেজরীবালের বাড়িতে।
এত সব কিছুর পরেও কিন্তু মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় ইনিংসের এই মমতা অনেক বেশি সুকৌশলী, রাজনীতিক হিসেবে বিচক্ষণতা প্রমাণ করতে অনেক বেশি সতর্ক। দিল্লি সফরকে তাই শুধু সমীকরণ গঠনের খেলায় সীমাবদ্ধ রাখতে তিনি চাইছেন না। পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ প্রশাসক হিসেবে দেশের শীর্ষ প্রশাসকের সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়াও যে এই দিল্লি সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, তা-ও প্রমাণ করতে চাইছেন মমতা। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক হয়েছে। এবং সেই বৈঠকেও এক ঢিলে বেশ কয়েকটি পাখিকে ঘায়েল করতে তৎপর থেকেছেন তৃণমূলের সর্বময়ী।
প্রথমত, বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য যা-ই থাক, আসন্ন সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত তীব্র হওয়ার সম্ভাবনাই থাক, রাজ্যের স্বার্থে তিনি আপসহীন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বাংলার দাবিদাওয়া আদায় করার স্বার্থে তিনি রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে জানেন।
দ্বিতীয়ত, বোঝাতে চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবিদাওয়া আদায়ের দায় যতই থাক, বিকল্প রাজনৈতিক সমীকরণটাকে আপাতত শিকেয় তুলে রাখার দায় তাঁর নেই। অর্থাৎ বোঝাতে চেয়েছেন, মাথা নত করে নয়, মেরুদণ্ড ঋজু রেখেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হচ্ছেন।
তৃতীয়ত, ভারসাম্যটা ধরে রাখতে চেয়েছেন। চিরচেনা একবগ্গা ভঙ্গিটা আর নয়, সহাবস্থানের বার্তা দিতে চেয়েছেন। মোদী তথা বিজেপি-র বিকল্প মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে মোদীকে ব্রাত্য রাখতে হবে, তেমন নীতি থেকে সরে আসতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর মধ্যে প্রশাসক আর রাজনীতিক সহাবস্থানে রয়েছেন।
মমতার নিজের জন্যই এই বার্তাটা খুব জরুরি এখন। দ্বিতীয় ইনিংসের সবে শুরু ঠিকই। কিন্তু মমতার লক্ষ্য এখন তৃতীয় ইনিংসে স্থির। সে খেলাটা কলকাতায় নয়, দিল্লিতে হবে। দলের অধিনায়ক হবেন না বলেছেন ঠিকই। তবে টিম ম্যানেজারের ভূমিকায় যে অবশ্যই থাকছেন, তা স্পষ্ট। সেই ভূমিকাই যে আরও বেশি কাঙ্খিত ও অনুচ্চারিত কোনও অভীষ্টে পৌঁছে দিতে পারে, সে কথা আর কেউ না জানুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব স্পষ্ট করে জানেন।