‘সীমান্তের জেলাগুলিতে অচেনা লোক দেখলেই প্রশাসনকে খবর দিন’

জঙ্গি মোকাবিলায় ও-পারে শেখ হাসিনার সরকার তৎপরতা বাড়ানোয় উদ্বেগ ছড়িয়েছে এ-পারে। যার জেরে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের নিয়ে শনিবার তড়িঘড়ি বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

জঙ্গি মোকাবিলায় ও-পারে শেখ হাসিনার সরকার তৎপরতা বাড়ানোয় উদ্বেগ ছড়িয়েছে এ-পারে। যার জেরে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের নিয়ে শনিবার তড়িঘড়ি বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নবান্ন সূত্রের খবর, ঢাকার গুলশনে জঙ্গি হামলার জেরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে শেখ হাসিনা সরকার। বাংলাদেশে চাপ বাড়লেই সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করে জঙ্গিরা। ফলে স্বভাবতই সতর্ক থাকতে চাইছে রাজ্য প্রশাসন।

স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ২২১৬ কিলোমিটার সীমান্তের ফাঁকফোকর গলে জঙ্গি-প্রবেশ আটকাতে আশু কিছু পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এ রাজ্যে দীর্ঘ সীমান্তপথে জঙ্গি কিংবা জামাতে ইসলামি সদস্যদের ঢোকা আটকাতে শুধু পুলিশি প্রহরাই আর যথেষ্ট নয় বলে মনে করা হচ্ছে। তাই এ বার প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি এবং গ্রামবাসীদের কাছেও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ‘‘সীমান্তের জেলাগুলিতে অচেনা, সন্দেহভাজন লোক দেখলেই প্রশাসনকে খবর দিন’’— এই মর্মে প্রচার চালাতে নির্দেশ গিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির বিডিও, থানার ওসি এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের কাছে।

Advertisement

টুইটারে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘সন্ত্রাসের কোনও ধর্ম নেই। আসুন অমানবিক জঙ্গিদের হারাতে সকলে মানবতার পক্ষে‌ লড়াই করি।’’ আর পরে আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রীতি রক্ষা করাটা এখন শান্তিরক্ষার সবচেয়ে বড় কাজ।’’

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পালিয়ে আসা জঙ্গিরা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের জেলাগুলিতে আশ্রয় নেয়। তার পর পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হলে তারা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য ও দেশের অন্য প্রান্তে। এ বারেও জঙ্গিরা সীমান্ত পেরোতে পারলে এই পথেই হাঁটবে বলে মনে করছেন নবান্নের কর্তারা। প্রশাসন সূত্রের খবর, সদ্য শেষ হওয়া নয়াদিল্লি-ঢাকা সচিব পর্যায়ের বৈঠকে হাসিনা সরকার এ রাজ্যের বিভিন্ন ডেরায় লুকিয়ে থাকা ৯৫ জন জঙ্গি, জামাতে ইসলামি সদস্য ও অপরাধীর নামের একটি তালিকা তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। এর মধ্যে ৩৮ জন জঙ্গি এবং জামাত সদস্য রয়েছে শুধু দক্ষিণবঙ্গেই। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ জোর কদমে এদের খুঁজে বের করার কাজে নেমেছে।

স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং কোচবিহারেই অধিকাংশ অপরাধী বা জামাত সদস্যরা লুকিয়ে আছে বলে ঢাকা দাবি করেছে। কিন্তু তারা খুব নির্দিষ্ট করে ঠিকানা দিতে পারেনি। তাই অপরাধীদের চিহ্নিত করে ধরপাকড় করতে আমাদের সময় লাগছে।’’ ওই স্বরাষ্ট্র কর্তার সংযোজন, ‘‘গুলশনের ঘটনার পর তো মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা পড়ল। এত দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে কে কখন ঢুকে পড়বে তার খোঁজ পাওয়া সত্যি মুশকিল।’’

স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, বিভিন্ন জেলায় লুকিয়ে থাকা জঙ্গিরা

এ রাজ্যে প্রভাব বাড়াতে শুরু করায় নতুন করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ঢাকার আগুনের আঁচ পড়ছে কলকাতাতেও। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তা জানান, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের

অন্যতম অভিযুক্ত এবং পলাতক সোহেল মেহফুজ ওরফে হাতকাটা নাসিরুল্লা, কওসর ওরফে বোমারু মিজান, তালহা শেখ বা ইউসুফ শেখরা হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে তাড়া খেয়ে এ রাজ্যে ঢুকে পড়েছিল। তার পর ধীরে ধীরে এই রাজ্যে তারা জামাতুল মুজাহিদিন-বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সংগঠন গড়ে তোলে। বেশ কয়েক বার তারা লালগোলা সীমান্ত দিয়ে বোমা পাচার করেছে।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সোহেল মেহফুজ বা হাতকাটা নাসিরুল্লা মুর্শিদাবাদের লালগোলা, মালদহ, বর্ধমানের আসানসোল এবং বীরভূমেও বেশ কিছুদিন করে ঘাঁটি গেড়ে ছিল। কিন্তু মেহফুজ ধরা না পড়ায় ওই সব এলাকায় এখনও জেএমবি-র কোনও মডিউল সক্রিয় রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা জানান, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে কুনিও হোশি নামে এক জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয় বাংলাদেশে। আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তখন নয়াদিল্লিকে জানিয়েছিল, ওই হত্যাকাণ্ডের অপরাধী আশ্রয় নিয়েছে কলকাতায়। এর পর টানা তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দমদম সেন্ট্রাল জেল এলাকা থেকে জাকির পাটোয়ারি নামে ওই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। তাকে বাংলাদেশ প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জাকির পাটোয়ারির সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে কোনও আইএস

জঙ্গির যোগ না মিললেও, সে ছিল জামাতের সক্রিয় কর্মী। নারায়ণগ়়ঞ্জের সাতটি খুনের আসামি তথা ৪৬টি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নুর মহম্মদও বছর দেড়েক আগে ধরা পড়েছে এই শহরেই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ঢাকার তাড়া খেয়ে সিলেটের জঙ্গল পেরিয়ে জঙ্গি নেতা বাংলা ভাইও এক সময় আশ্রয় নিয়েছিল মেঘালয় সীমান্তের এক গ্রামে এসে।

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, জামাতের ঘাঁটি রয়েছে প্রধানত বাংলাদেশের সাতক্ষীরা-রাজশাহি এবং উত্তরবঙ্গের লাগোয়া জেলাগুলিতে। সেই কারণে সচরাচর বসিরহাট, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং কোচবিহারের সীমান্ত দিয়ে তারা এ দেশে ঢোকে। এ ছাড়া সিলেট, ময়মনসিংহ সীমান্তও অনেক সময়েই ব্যবহার করে তারা।

নবান্ন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে সীমান্ত সিল করার ব্যাপারে দিল্লির সঙ্গে কথা হয়েছে রাজ্যের। পাশাপাশি সীমান্তের হোটেল এবং পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরে থাকা ডেরাগুলিতে টানা তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী ৬ জুলাই একই দিনে ইদ ও রথযাত্রা। তাই এখন প্রশাসনকে অতি-সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘অস্থিরতার সময় অনুপ্রবেশ ঠেকানো মূলত বিএসএফের কাজ। ও পার থেকে কেউ যাতে এ পারে আসতে না পারে, সে জন্য বিএসএফকে বলা হয়েছে।’’ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর এক কর্তা বলেন, ‘‘এ রাজ্যের সব কটি ব্যাটেলিয়নকে সীমান্তে রাতদিনের জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। সদর ছেড়ে সীমান্তে যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন কম্যান্ডান্টরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন