সোমবার বিধানসভায় মানস ভুঁইয়া। ছবি: সুদীপ আচার্য
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, সে যদি আচমকা এসে পড়ে! তা হলে কেমন ধুন্ধুমার বেধে যেতে পারে, সাক্ষী থাকল বিধানসভা!
বিধানসভায় যখন সোমবার সকালে ঢুকলেন, তখন খবর এসেছে ভোটের ঠিক আগে সবংয়ে তৃণমূল কর্মী জয়দেব জানার খুনের ঘটনায় মেদিনীপুর আদালতে তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। চিন্তিত মুখ। কিন্তু তার মধ্যেও ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলছেন, কংগ্রেসের মধ্যে তাঁর ‘মমতাপন্থী’ দুর্নাম এ বার অন্তত মুছবে! সন্ধ্যায় বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের ডাক অগ্রাহ্য করে যখন বিধানসভা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান। কংগ্রেসে উথাল পাতাল চলছে, বিরোধী ‘জোট’ও ছত্রভঙ্গ!
এই দুই ঘটনার মাঝে ঘটেছে বলতে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার একান্তে একটা বৈঠক। তার পরেই নাটকীয় পট পরিবর্তন!
নিজেদের অধিকার ছেড়ে পিএসি-র চেয়ারম্যানের পদ ‘জোটসঙ্গী’ বামেদের দিতে চেয়েছিল কংগ্রেস। দলের সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সবুজ সঙ্কেত আদায় করে অধিবেশনের শেষ দিনে প্রায় ছুটতে ছুটতে বিধানসভায় পৌঁছে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা মান্নান। তাঁর লিখিত প্রস্তাব ছিল, পিএসি-র চেয়ারম্যান করা হোক বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীকে। কিন্তু ওই এক বৈঠকের পরে বিধানসভায় বসে পিএসি-র চেয়ারম্যান হিসেবে মানসবাবুর নাম ঘোষণা করে দিলেন স্পিকার। আর তার আগে তথ্য কমিশনার নিয়োগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বৈঠক করতে গিয়ে মান্নানকে প্রশ্ন শুনতে হল, কেন মানসবাবুকে পিএসি-র চেয়ারম্যান করা হচ্ছে না! সন্দেহটা হয়েছিল তখনই! পরে সত্যি সত্যিই নিজের দলের হাতে অবাঞ্ছিত পদ এসে পড়ায় রাগে-দুঃখে সভা থেকে ওয়াক আউট করতে হল মান্নানদের! সঙ্গে সুজনেরাও।
বস্তুত, পিএসি-র চেয়ারম্যান পদে কংগ্রেসের দিক থেকে অন্যতম দাবিদার ছিলেন মানসবাবুই। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক কার্যকলাপ দলের মধ্যে মানসবাবুর জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, অন্য দলের নেতাকে অনেক বেশি ‘সুজন’ মনে হচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্বের! পাছে মানসবাবুকে পিএসি-র চেয়ারম্যান করতে হয়, বলতে গেলে এই পরিস্থিতি এড়াতেই সিপিএমের হাতে কমিটি সঁপে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সরকার পক্ষের চালে সে গুড়ে বালি! উল্টে কংগ্রেসে কাজিয়া তুঙ্গে!
কেন কংগ্রেসকে পিএসি-র চেয়ারম্যানের পদ দেওয়া হল, কংগ্রেস বিধায়কেরাই তার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন— এমন অভিনব দৃশ্য এ দিন দেখা গিয়েছে বিধানসভায়! কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখ নিয়ে মান্নানদের পিছু নিয়ে সভা ছেড়েছেন সুজনবাবুরাও। বিধানসভার মধ্যেই মান্নান যখন প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মানসবাবু তখন পাশে দাঁড়িয়ে রা কাড়েননি। পরে বাইরে বেরিয়ে মান্নান মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি স্পিকারের বিরুদ্ধেও ‘ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ থাকার অভিযোগ তুলে দিয়েছেন। ক্ষিপ্ত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী নির্দেশ দিয়েছেন, হাইকম্যান্ডের সম্মতি নিয়ে যেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেখানে বিশৃঙ্খলা মানা যাবে না। মানসবাবুকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে। মানসবাবু কিন্তু রাত পর্যন্ত নীরব থেকে রহস্য বাড়িয়েছেন! প্রকাশ্যে তাঁর পাশে দাঁড়ান শুধু এআইসিসি-র সম্পাদক শুভঙ্কর সরকার।
সন্ধ্যার এই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছনোর আগে দিনটাই ছিল নাটকীয়। অভিযুক্তের নাম মানসবাবু বলেই হয়তো গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর পেয়েও কংগ্রেস বিধায়কদের সে ভাবে হইচইয়ে পড়তে দেখা যায়নি। বিরোধী দলনেতা অবশ্য বলেছিলেন, ‘‘এটা মানসের একার লড়াই নয়। কংগ্রেস প্রতিবাদ কর্মসূচি নেবে।’’ যে বক্তব্যকে মোটেও আমল দেননি মানসবাবু। বরং, অধিবেশনের বিরতির সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। তাঁর দাবি, সবংয়ে সেচের সমস্যা নিয়ে কথা ছিল। মামলা নিয়ে কোনও কথা হয়নি। পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বৈঠকে গিয়ে মান্নান পিএসি নিয়ে প্রশ্ন শোনেন মমতার কাছে!
মান্নান ও বিরোধী দলের সচেতক মনোজ চক্রবর্তী বোঝেন শাসক পক্ষ অন্য খেলা খেলবে। মানসবাবুকেই পিএসি-র চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হতে পারে। প্রথা অনুযায়ী, বিধানসভার কোনও কমিটিতে সদস্য হিসাবে মনোনয়নের জন্য সব দলকেই প্রথমে নাম পাঠাতে হয়। তার পরে চেয়ারম্যান মনোনীত করেন স্পিকার। কংগ্রেস পিএসি-র সদস্য হিসাবে আগেই যাঁদের নাম পাঠিয়েছিল, তার মধ্যে শঙ্কর সিংহ, সুখবিলাস বর্মাদের সঙ্গে মানসবাবুর নামও ছিল। মান্নানেরা যখন বুঝতে পারেন ওই তালিকা থেকে স্পিকারকে দিয়ে চেয়ারম্যান বাছিয়ে নেওয়া হতে পারে, তখন তাঁরা আবার চিঠি লিখে জানান মানসবাবু পিএসি-র সদস্য হতেই চান না! কিন্তু সেই চিঠির অস্তিত্ব স্বীকারের আগেই স্পিকার মানসবাবুকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।
মান্নানের ক্ষোভ, ‘‘পিএসি-র চেয়ারম্যান বাছা হয় বিরোধী দলনেতার মত নিয়ে। স্পিকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে ঠিকই। কিন্তু লিখিত ভাবে আমরা সিপিএমকে পদ ছাড়ার কথা জানানোর পরেও স্পিকার ষ়়ড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন! এতে মুখ্যমন্ত্রীরও ভূমিকা আছে।’’ তাঁরা এই সিদ্ধান্ত মানছেন না বলে জানান মান্নান। সুজনবাবুও বলেন, পদের আকাঙ্খা তাঁদের ছিল না। কিন্তু এই ঘটনা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক ইঙ্গিত। প্রসঙ্গত, মানসবাবুকে পিএসি দিয়ে সুজনবাবুকে অন্য একটি হাউস কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন স্পিকার। তাঁর যুক্তি, ‘‘পিএসি-র চেয়ারম্যান পদ বিরোধী দলের প্রাপ্য। প্রধান বিরোধী দলকেই তো পদ দেওয়া হয়েছে!’’
পদ পেয়েই এখন বিপদে পড়েছে কংগ্রেস!