বিকাশ বেঁচে, ধরা পড়ার পরে জানলেন মা

গাড়ি থেকে নামতেই ঝাঁঝরা করে দিল প্রশ্ন। কী ব্যপার? কোথা থেকে আসছেন? কাকে চাই? কার সঙ্গে দেখা করবেন? গাছের তলায় বসে জনা বারো যুবকের দল। জঙ্গলঘেরা মেটালা গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থেকে সারেঙ্গা যাওয়ার পিচ রাস্তাকে পিছনে অনেক দূরে ফেলে মোরাম বিছানো পথে লাল ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ঢোকার পরে আড়চোখে দেখে নিলেন ওই যুবকেরা। নামতেই শুরু হল প্রশ্ন।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ ও তাপস ঘোষ

গোয়ালতোড় ও মগরা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩৮
Share:

মেটালা গ্রামের বাড়িতে বিকাশের মা ধোনি হেমব্রম। ছবি: শৌভিক দে

গাড়ি থেকে নামতেই ঝাঁঝরা করে দিল প্রশ্ন। কী ব্যপার? কোথা থেকে আসছেন? কাকে চাই? কার সঙ্গে দেখা করবেন?

Advertisement

গাছের তলায় বসে জনা বারো যুবকের দল। জঙ্গলঘেরা মেটালা গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থেকে সারেঙ্গা যাওয়ার পিচ রাস্তাকে পিছনে অনেক দূরে ফেলে মোরাম বিছানো পথে লাল ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ঢোকার পরে আড়চোখে দেখে নিলেন ওই যুবকেরা। নামতেই শুরু হল প্রশ্ন।

উত্তর শুনে আশ্বস্ত হয়ে একজন বললেন, ‘‘আসুন আমার সঙ্গে।’’ তাঁর পিছনে কিছুটা এগোতেই একটা মাটির ঢিবির কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ঢিবির দু’দিকে দু’টি খুঁটিতে দু’টি গরু বাঁধা। আঙুল তুলে বললেন, ‘‘এটা এক সময়ে বাড়ি ছিল। পুলিশ এসে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছে।’’

Advertisement

যাঁর ‘মাটিতে মিশে যাওয়া’ সেই বাড়ির সামনে এই কথাবার্তা, তিনি মাওবাদী নেতা বিকাশ ওরফে মনসারাম হেমব্রম। শনিবার সেই ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ বিকাশ এবং তাঁর স্ত্রী তারাকে গ্রেফতার করে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। যে দম্পতি এক বছর ধরে বাসা বেঁধেছিলেন হুগলির মগরা থানা এলাকার চাঁপারুইতে।

বিকাশ ছিলেন মাওবাদীদের রাজ্য মিলিটারি কমিশনের প্রধান। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৮-এর ডিসেম্বর থেকে ২০১১-র মাঝ পর্যন্ত ৫৫টি মামলা রয়েছে। তারাও সাঁকরাইল থানায় হামলা, ওসি-কে অপহরণ, শিলদায় ইএফআর ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ২৪ জন জওয়ানকে হত্যা, গিধনি বাজারে গুলি করে পাঁচ ইএফআর জওয়ানকে হত্যার মামলায় অভিযুক্ত। শক্তপোক্ত চেহারার সেই যুবককে দেখার সুযোগ হয়েছিল কয়েক বছর আগে কিষেণজির পাশে। বিকাশের কাঁধে তখন ইনসাস, কোমরে নাইন এমএম।

দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে ১৫ বছর আগে উধাও হয়ে যায় গ্রামের শান্ত ছেলে মনসারাম। সারেঙ্গার এক স্কুলে পড়ত। স্কুলেরই হস্টেলে থাকত। ছুটিতে বাড়ি আসত। হস্টেল থেকেই একদিন বাড়িতে উধাও হওয়ার খবর আসে। ছোট ভাই গোরাচাঁদ বলেন, ‘‘আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবা অনেক খুঁজেছিল। পায়নি।’’ তার বছর খানেকের মধ্যে পুলিশ আসে গ্রামে। অভিযোগ, জেরার সঙ্গে চলে অকথ্য অত্যাচার। ভাতের হাঁড়ির মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয় কেরোসিন। চলে বেধড়ক মারধর। তখনই মনসারামের মা ধোনি হেমব্রম জানতে পারেন, ছেলে নতুন নাম নিয়েছে— বিকাশ।

সময় হেমব্রম বিকাশের গ্রামের বন্ধু। বললেন, ‘‘আমাদের গ্রামে কত লোকের নামে যে মামলা রয়েছে তা গুনে শেষ করতে পারবেন না। আমি নিজে তিন বছর জেল খেটে এসেছি। আমাদের একটাই দোষ। আমরা বিকাশের গ্রামে থাকি।’’ তাই, বাইরে থেকে লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে কেউ গ্রামে ঢুকলে সজাগ, সন্ত্রস্ত হয়ে যান তাঁরা। বিশদে জেনে নিতে চান পরিচয়। তাঁর কথায়, ‘‘দফায় দফায় কতবার যে পুলিশ-সিআইডি ঢুকে অত্যাচার করেছে তা বলার নয়।’’

তিনিই নিয়ে গেলেন বিকাশের মায়ের কাছে। মাঝে ১৫ বছর কেটে গিয়েছে, ছেলের সঙ্গে দেখা নেই। ছেলেও যোগাযোগ করেনি। দেওরের বাড়িতে আশ্রিত ধোনি জানালেন, রবিবার লোক মারফত জেনেছেন ছেলের গ্রেফতার হওয়ার খবর। ছেলে বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, তা-ই জানতেন না। এ দিন জানলেন, বেঁচে রয়েছে।

২০১১-য় কিষেণজি নিহত হওয়ার পর বিকাশ ও তারা গা-ঢাকা দেন। পশ্চিম মেদিনীপুর-পুরুলিয়ার জঙ্গলের মাওবাদী ডেরা থেকে পালিয়ে প্রায় দু’আড়াইশো কিলোমিটার দূরে হুগলির মগরা থানা এলাকার চাঁপারুই এলাকাই ঘর বাঁধার জন্য বেছে নেন বিকাশ-তারা। ডিভিসি খালের পাড়ে যেখানে লোকসমাজ থেকে তাঁদের আড়াল করে রাখবে বাঁশবন আর সাবাই ঘাসের জঙ্গল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

রবিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দু’কাঠা জমিতে বিকাশ-তারার একচালা মাটির বাড়ি সামনে কিছুটা জায়গায় শাকসব্জির চাষ হচ্ছে। বাড়ির চারদিকে কাঁটা গাছের ঝোপ। বাড়ির জানালা বলে কিছু নেই। শুধু ছোট্ট একটা ঘুলঘুলি। আশপাশটা নির্জন। কাছের বাড়ি অন্তত ২০০ মিটার দূরে।

স্থানীয়েরা অবশ্য বিকাশকে এত দিন চিনতেন সুদীপ টুডু নামে। রবিবারই তাঁরা জানতে পারেন সুদীপের আসল পরিচয়। গ্রামবাসীরা জানান, সুদীপ মুরগি পুষতেন। গ্রামে খুব একটা মিশতেন না। তারা অন্যের জমিতে খেতমজুরি করতেন। সুনীল কিস্কু নামে এক গ্রামবাসীর কথায়, ‘‘খুব একটা মেলামেশা না করলেও সুদীপ কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। যখন বেরোতেন, কোমরে চওড়া বেল্ট বাঁধা থাকত। লম্বা জামাটা প্যান্টের উপর দিয়ে ছাড়া থাকত।’’

সেই সুদীপই মাওবাদী নেতা বিকাশ, জানতে পেরে গ্রামবাসীদের অনেকে যেমন আতঙ্কিত, তেমনই অনেকে আবার নানা কৌতূহলও প্রকাশ করেছেন। তবে, গোয়ালতোড়ে মেটালা গ্রামে বিকাশের মা ধোনিদেবী যেন কিছুটা উদাস ছেলের খবর শুনে।

যাবেন ছেলেকে দেখতে?

দাওয়ায় উবু হয়ে বসে চেয়ে রইলেন ধোনি। জবাব দিলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন