দেখলে মনে হবে, মামুলি শুভেচ্ছাজ্ঞাপক কার্ড। কিন্তু আসলে ১০ লক্ষ টাকা তোলা চেয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে ওই কার্ডের মাধ্যমে। প্রেরক হিসেবে নাম ছাপা আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডলের। সঙ্গে ‘সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, সিপিআই (মাওবাদী)’ লেখা চৌকো রাবার স্ট্যাম্প। তৃণমূলমুক্ত বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ওই ‘আর্থিক সহযোগিতা’ প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে কার্ডে ছাপানো বার্তায়। সেই সঙ্গে ওই কার্ডেই হাতে লেখা হুমকি— চিঠির বিষয়ে কাউকে জানালে বা সংগঠনের কর্মীদের কারও ক্ষতি হলে খেসারত দিতে হবে!
দিন পাঁচেক আগে ওই চিঠি পেয়েছেন জঙ্গলমহলের লালগড় এলাকার বিভিন্ন তল্লাটের কয়েক জন বাসিন্দা। পেশায় কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ব্যাঙ্ককর্মী, কেউ বা শিক্ষক। কেউ নিজের দোকানে ফেলে দিয়ে যাওয়া কার্ড কুড়িয়ে পেয়েছেন, কারও অনুপস্থিতিতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে লাগাতার ফোনও গিয়েছে প্রাপকদের মোবাইলে। তোলা চেয়ে যে টাকা দাবি করা হয়েছে, তার পরিমাণ সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা হলেও পাঁচ, দুই, এমনকী এক লক্ষ টাকাও চাওয়া হয়েছে কয়েক জনের কাছে।
ওই হুমকি-কার্ড প্রাপকদের কেউ অবশ্য এখনও পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাননি। কেন? লালগড়ের এসআই চকের এক কার্ড প্রাপকের সাফ জবাব, “ভয়ে জানাইনি। চার-পাঁচ বছর আগের আতঙ্কের দিনগুলো তো ভুলে যাইনি। আমি পুলিশকে কিছু জানাতে যাব না।” তবে খবর পেয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি)।
আজ, রবিবার সিপিআই (মাওবাদী)-র দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০০৪-এর ২১ সেপ্টেম্বর মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার (এমসিসি) ও জনযুদ্ধ (সিপিআই-এমএল-পিডব্লিউ) মিশে জন্ম হয় সিপিআই (মাওবাদী)-র। এই রাজ্যে ওই সংযুক্তিকরণ উপলক্ষে ‘মিলন সমাবেশ’ হয়েছিল বেলপাহাড়ির চাকাডোবায়।
তার আগে থেকেই অবশ্য মাওবাদীদের হাতে পুলিশ ও সিপিএমের নেতা-কর্মীরা খুন হচ্ছিলেন। ২০০৩-এর ১১ অক্টোবর মাওবাদীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হন পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানার তদানীন্তন ওসি নীলমাধব দাস। ২০০৪-এ সিপিআই (মাওবাদী) তৈরি হওয়ার পর হিংসার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তার পর ২০০৮-এর নভেম্বরে লালগড়ে আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগকে কেন্দ্র করে গোটা জঙ্গলমহলে শুরু হওয়া আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় মাওবাদীরা। ২০০৯ থেকে ২০১১— জঙ্গলমহলে পুলিশ ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে মাওবাদীদের হাতে সাড়ে পাঁচশোরও বেশি মানুষ খুন হন।
তবে ২০১১-র নভেম্বরে যৌথবাহিনীর হাতে মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি নিহত হওয়ার পর মাওবাদী কার্যকলাপে ভাটা পড়ে। গত দু’বছরে মাওবাদী হিংসায় কোনও প্রাণহানি হয়নি। মূলত সে জন্যই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, জঙ্গলমহল এখন হাসছে।
এই প্রেক্ষাপটে লালগড়ে মাওবাদীদের নামে তোলা চেয়ে লিখিত হুমকি-চিঠি কয়েক জনের কাছে আসা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে এক রকম ছন্দপতন। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বেলপাহাড়ি কিংবা আড়শার মতো এলাকায় মাওবাদী নামাঙ্কিত ব্যানার-পোস্টার পড়ার তুলনায় তোলা চেয়ে চিঠি আসাটা অনেক বেশি গুরুতর বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, অন্য রাজ্য থেকে এসে রাতের অন্ধকারে ব্যানার-পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু তোলা চেয়ে চিঠি বাড়ি বয়ে দিয়ে যাওয়া ও তার পর ফোন করে খবর নেওয়ার ঘটনা অন্য রকম। আইবি-র এক কর্তার বক্তব্য, এক জনের কাছ থেকে মাওবাদীরা দুম করে এক লপ্তে এত টাকা দাবি করবে, এটা কেমন অস্বাভাবিক। আবার কেউ যদি নিছক বদমায়েশি করে, সে ক্ষেত্রেও কার্ড কেনা, চিঠি ছাপানো, রাবার স্ট্যাম্প তৈরি করা— এত সব ঝক্কি কেন সে পোয়াতে যাবে? অর্থাৎ, এ চিঠি মাওবাদীদেরই, এটা যেমন নিশ্চিত করে বলা কঠিন, মাওবাদীদের নয় বলাটাও তেমনই কঠিন।
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, মাস তিনেক আগেও মাওবাদীদের অস্তিত্ব নিয়ে রীতিমতো পত্রযুদ্ধ বেধেছিল রাজ্য গোয়েন্দা শাখা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্যে রাজ্যের তৈরি নিজস্ব বাহিনী কাউন্টার ইনসারজেন্সি ফোর্স (সিআইএফ)-এর মধ্যে। মাওবাদীদের বিভিন্ন স্কোয়াডের গতিবিধি নিয়ে আইবি দৈনিক রিপোর্ট দেয় সিআইএফ, সিআরপি ও রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের একাংশকে। কিন্তু অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া কয়েকটি জায়গায় মাওবাদী স্কোয়াডের গতিবিধি রয়েছে বলে আইবি রিপোর্টে দাবি করা হলেও সিআইএফ কড়া চিঠি পাঠিয়ে বলে, এমন তথ্য আদৌ ঠিক নয়। আইবি রিপোর্টে যে সব জায়গার কথা বলা হয়েছে, সেখানে বর্তমানে মাওবাদীদের অস্তিত্বই নেই। সিআইএফ এ দাবিও করে, ‘আইবি-র চরেরা কোনও খবরই রাখে না।’ এই নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে পত্রযুদ্ধ হয়েছিল। তবে লালগড়ের সাম্প্রতিক ঘটনার পর তাঁদের তথ্যকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে অন্যেরা দু’বার ভাববেন বলেই মনে করছেন আইবি অফিসারদের একাংশ। তাঁদের মতে, কিষেণজি নিহত হওয়ার পর সুচিত্রা মাহাতোর আত্মসমর্পণ ছাড়া প্রথম সারির মাওবাদী নেতাদের কাউকে গ্রেফতার বা আত্মসমর্পণ করানো যায়নি। এটা অবশ্যই ব্যর্থতা।
আইবি-র এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “আকাশ, বিকাশ, রঞ্জিত পাল বা জয়ন্তকে কিন্তু আজও ধরা গেল না। এটাই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।” তা ছাড়া, মদন মাহাতো ও শ্যামলও নিয়মিত বেলপাহাড়ির ঝাড়খণ্ড লাগোয়া তল্লাটগুলোয় ঢুকছে বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। আইবি রিপোর্টে রঞ্জিত পাল ও জয়ন্তর গতিবিধির উল্লেখ থাকছে নিয়মিত, অথচ তাদের ধরা যাচ্ছে না। আবার লালগড়ের কামরাঙির জঙ্গলে সম্প্রতি বিকাশ ও আকাশ গিয়ে শ’খানেক লোক নিয়ে মিটিং করলেও সেই খবর গোয়েন্দারা জেনেছেন অনেক পরে।
এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “তোলা চেয়ে হুমকি দিয়ে যে বা যারাই কার্ড পাঠাক, আসল কথা হল মাওবাদীদের নাম করে আসা বার্তায় লালগড়ের মানুষের মধ্যে এখনও ঠকঠকানি ধরছে। অর্থাৎ আতঙ্ক মোছেনি আজও। মাওবাদী পার্টির দশ বছর পূর্তির মুখে এটা আমাদের কাছে নিশ্চয়ই উদ্বেগের বিষয়।”