নলেনের আকাল, বাজার ছেয়েছে ভেজাল গুড়ে

শীতের মরসুমে পাটালি ও ঝোলা গুড়ের বিপুল চাহিদার সুযোগ নিয়ে, আইনের ফাঁক গলে শহর ও শহরতলির বাজার ভরেছে ভেজাল নলেন গুড়ে।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৫:৫৯
Share:

তৈরি হচ্ছে ভেজাল গুড়। নিজস্ব চিত্র

খেজুর গাছ কম। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার লোক, শিউলির সংখ্যা আরও কম। ফলে সেই রস থেকে নলেন গুড় তৈরিতে বেশ টান।

Advertisement

তবু বাজারে অভাব নেই নলেন গুড়ের!

শীতের মরসুমে পাটালি ও ঝোলা গুড়ের বিপুল চাহিদার সুযোগ নিয়ে, আইনের ফাঁক গলে শহর ও শহরতলির বাজার ভরেছে ভেজাল নলেন গুড়ে।

Advertisement

নিয়মমতো, শীত পড়ার মাস তিনেক আগে থেকে শুরু হয় খেজুর গাছের নিয়মিত পরিচর্যা। পরে ঠান্ডা পড়তেই খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে তা আগুনে জ্বাল দিয়ে নলেন গুড় তৈরি করা হয়। কাকভোরে সেই রস সংগ্রহ করার পরেই হেঁসেলে উনুনে কাঠ জ্বালিয়ে বড় লোহার কড়াইয়ে ঝোলা গুড় তৈরির জন্য রস পাক দিতে শুরু করেন তাঁরা। গাছ থেকে রস নামানোর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তাতে পাক দিতে হয়। কারণ রোদের তাপ বাড়লেই সেই রস নষ্ট হয়ে যায়।

তবে জয়নগরের চারপাশে এই সময়টায় গুড় তৈরি হচ্ছে দিনরাত। কারণ ভেজাল তৈরিতে তেমন কোনও নিয়ম নেই।

এমন গুড় তৈরির একটি কারখানায় হাজির হয়ে দেখা গেল, বাড়ির পিছনে দোতলায় একটি বড় ঘর। জানলা বন্ধ। টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। ঘরের এক দিকে বস্তাভর্তি ভেলিগুড়, লোহার কড়াইয়ে রসের পরিবর্তে টগবগ করে গরম জলে ফুটছে চা পাতা। ঘরের আর এক দিকে ছোট ছোট প্যাকেটে রাখা খাওয়ার সোডা। কয়েকটি হাড়িতে রয়েছে আসল নলেন গুড়। একাধারে রয়েছে বস্তা ভর্তি চিনি।

এমনই একটি ঘরের এক দিকে বসে ‘ভেজাল’ নলেন গুড়ের সেই কারখানার মালিক বলেন, ‘‘কোনও বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করি না আমরা। অল্প আসল নলেন গুড়ের সঙ্গে চায়ের লিকার, ভেলি গুড় ও চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় ভেজাল নলেন গুড়। আর গন্ধের জন্য এক ফোঁটা এসেন্স!’’ সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে ওই কারবারি নিয়ে আসেন দু’টি বোতল। হাসিমুখে বলেন, ‘‘এতেই ভরা আছে নলেন গুড়ে গন্ধ’’ তিনি জানান, দক্ষিণ ভারত থেকে নিয়ে আসা এই এসেন্স এক ফোঁটা করে ঢালা হয় প্রতি কেজি গুড়ে। এই একটি মাত্র রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় ভেজাল গুড়ে, আশ্বাস দিলেন ওই কারবারি।

ওই এলাকার আর এক গুড় কারবারি জানালেন, এমন পদ্ধতিতে গুড় তৈরি করতে কেজি প্রতি খরচ পড়ছে ৪০ টাকার কাছাকাছি। আর পাইকারি বাজারে সেই গুড় বিক্রি করছেন ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। কলকাতা-সহ রাজ্যর প্রায় সব জায়গায় ওই কারখানা থেকে ভেজাল গুড় সরবরাহ করা হয়। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এই কারবারে প্রায় ১০০ শতাংশ মুনাফা। ফলে মোয়া ব্যবসায়ীদের দাবি, শীতের মরসুমে জয়নগর ও বহড়ু-সহ আশাপাশের এলাকায় প্রায় ব্যাঙের ছাতার মতো শ’পাঁচেক কারখানা গজিয়ে ওঠে। দেদার ভেজাল নলেন গুড় হাড়িতে ভরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় কলকাতা-সহ দেশের নানা প্রান্তে। এক মোয়া ব্যবসায়ীর অভিযোগ, এ ভাবে তিন মাসে প্রায় কয়েক কোটি টাকার মুনাফা করে ভেজাল কারবারিরা।

ধরা পড়ে না এই ভেজাল গুড়ের ব্যবসা? জয়নগরের এক ভেজাল গুড় কারবারির কথায়, ‘‘গুড়ের ক্ষেত্রে আসল-নকলের ফারাক ধরা খুব মুশকিল। অধিকাংশ মানুষ কোনও দিন আসল নলেন গুড়ের স্বাদই পাননি। তাই স্বাদ ও গন্ধের বিষয়ে বেশি সচেতন নন সাধারণ ক্রেতারা।’’

এক মোয়া ব্যবসায়ী অবশ্য ভেজাল ও আসলের ফারাক বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর কথায়, আসল নলেন গুড়ের রং অনেকটা সর্ষের তেলের মতো আর গন্ধ হয় কোমল। ভেজাল নলেন গুড়ের রং অনেকটাই লালচে এবং এসেন্স মেশানোর ফলে গন্ধও হয় খুব তীব্র। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট দফতর সূত্রে খবর, নলেন গুড়ের কোনও পেটেন্ট নেই। সেই কারণে নলেন গুড় আসলে কী বস্তু, তা জানার কোনও অবকাশও নেই। ফলে নলেন গুড়ের নাম করে যা বিক্রি হয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও পরিকাঠামোই নেই পুলিশ কিংবা প্রশাসনের।

এই সুযোগেই নিঃশব্দ-নিরবে এবং সম্পূর্ণ নির্ভয়ে রমরমিয়ে বেড়েই চলেছে ভেজাল গুড়ের ব্যবসা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন