নার্সের ভুল ইঞ্জেকশনে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে আট দিনের মেয়ে

জন্মের সময়ে ওজন ছিল তিন কেজি। সুস্থ-সবল, ফুটফুটে মেয়ে। সারা দিন হাসি আর আঙুল চোষা। গত বুধবার দুপুরে নতুন জামা পরে সেজেগুজে তৈরি হয়েছিল মায়ের কোলে চড়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার বদলে গোটা শরীর শক্ত হয়ে ফুলে যাওয়ায় তাকে যেতে হল ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)-এ। সেখানেই আট দিনের মেয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৫
Share:

অসুস্থ হওয়ার আগে সেই শিশু।

জন্মের সময়ে ওজন ছিল তিন কেজি। সুস্থ-সবল, ফুটফুটে মেয়ে। সারা দিন হাসি আর আঙুল চোষা। গত বুধবার দুপুরে নতুন জামা পরে সেজেগুজে তৈরি হয়েছিল মায়ের কোলে চড়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার বদলে গোটা শরীর শক্ত হয়ে ফুলে যাওয়ায় তাকে যেতে হল ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)-এ। সেখানেই আট দিনের মেয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।

Advertisement

কেন? কারণ, সরকারি হাসপাতালের নার্স তাকে ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই লিখিত ভাবে এ কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। তাঁরা আরও জানান, ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেই শিশুটির মাথা, ঘাড়-বুক সহ শরীরের উপরের অংশ শক্ত হয়ে যায়। শিশুটি নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। তার কিডনি, ফুসফুস, স্নায়ুতন্ত্র ভাল করে কাজ করছে না। হাসপাতাল সূত্রের খবর, শিশুর শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে, ঝুঁকি না নিয়ে বুধবার বিকেলেই শিশুটিকে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এসএনসিইউ-এ। সেখানে আপাতত ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে তাকে। এখনও পর্যন্ত অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।

কোনও জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তের ঘটনা নয়। কলকাতা শহরের প্রায় কেন্দ্রে নামী সরকারি প্রসূতি হাসপাতাল লেডি ডাফরিনের এই ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়েছে স্বাস্থ্য দফতরও। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শিশুর রেফারাল সার্টিফিকেটেও লিখিত ভাবে ভুল ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। অভিযুক্ত নার্সকে এর পরে বসিয়ে দেওয়া হয়। ডাফরিনের সুপার নীলাঞ্জনা সেন এবং ডেপুটি নার্সিং সুপারকে নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘অমার্জনীয় অপরাধ। শুক্রবারের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।’’ জানা গিয়েছে, ওই শিশুটিকে ভিটামিন কে’র ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা ছিল। তার বদলে অভিযুক্ত নার্স একটি কড়া ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।

Advertisement

লেডি ডাফরিনের রেফার করা চিঠি।— নিজস্ব চিত্র

সেটি ব্যথা কমানোর জন্য সদ্যপ্রসূতিদের অনেক সময় দেওয়া হয়। শতপথীর কথায়, ‘‘কী ভাবে নার্স ভিটামিন কে’র সঙ্গে ওই ইঞ্জেকশন গুলিয়ে ফেললেন, বুঝতে পারছি না।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ফার্মাকো ভিজিল্যান্স প্রোগ্রাম’-এর অন্যতম কেন্দ্র রয়েছে কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। ওষুধের বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নজর রাখাই তাদের কাজ। সেই কেন্দ্রের প্রধান শান্তনু ত্রিপাঠীর কথায়, ‘‘যে ইঞ্জেকশন ওই শিশুকে দেওয়া হয়েছে, সেটি বড়দের দিলেই অনেক রকম নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয়। কোনও সদ্যোজাতকে বিনা কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজে ওই ইঞ্জেকশন দিলে তার বাড়াবাড়ি রকম ‘রেসপিরেটরি ডিপ্রেশন’ বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে বা শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যেতে পারে।’’ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, শিশুটির চিকিৎসায় যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, তার জন্য মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় শিশুর অভিভাবকেরা বৌবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।

অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুটি ঘুটিয়ারি শরিফের শ্রীনগর গাজিপাড়ার বাসিন্দা জামসউদ্দিন জমাদার ও তাঁর স্ত্রী মনরুদা সর্দার বিবির মেয়ে। গত ৩০ অগস্ট আসন্নপ্রসবা মনরুদা লেডি ডাফরিন হাসপাতালে ভর্তি হন। সে দিন ভোর চারটে নাগাদ (হিসেব মতো ৩১ অগস্ট) সিজার করে মেয়ে হয় মনরুদার। মা ও মেয়ে কারও কোনও সমস্যা ছিল না বলে চিকিৎসকেরাই জানিয়েছেন। এসএনসিইউ-এর সামনে কাঁদতে কাঁদতে মনরুদা জানালেন, তাঁর ছুটি সোমবারই হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মেয়ের পেটটা পরিষ্কার হচ্ছিল না বলে ডাক্তারবাবুরা ছাড়ছিলেন না। মঙ্গলবার পেট পরিষ্কার হল। ডাক্তারবাবুরা তার কিছু শারীরিক পরীক্ষাও করালেন। সব রিপোর্টই ভাল। বুধবার মেয়েকে সাজিয়ে বাড়ি যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। এমন সময়ে দেখেন, বাচ্চার কাঁচা নাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এক জন মহিলা ডাক্তার ছিলেন। তাঁকে ডেকে দেখাই।’’ ডাক্তার রক্ত আটকাতে ওয়ার্ডের নার্সকে ভিটামিন কে ইঞ্জেকশন দিতে

বলেন। ‘‘নার্স ইঞ্জেকশন দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেয়েটা কেমন শক্ত হয়ে গেল। নড়াচড়া বন্ধ। হাত-পা, চোখের দৃষ্টি কেমন যেন স্থির।’’

মনরুদা ও তাঁর স্বামী ছুটে যান ওই মহিলা ডাক্তারের কাছে। তিনি নার্সকে ডেকে কী ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে শুনেই প্রচণ্ড চিৎকার করতে থাকেন। ‘‘একটা কাগজে অনেক কিছু লিখে আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেডিক্যালে যেতে বললেন,’’ এইটুকু বলেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন মনরুদা। তাঁকে কোনও মতে ধরে মাটিতে শোয়াতে শোয়াতে স্বামী জামসউদ্দিন বললেন, ‘‘আমরা গরিব খেটে খাওয়া লোক। কিন্তু আমার অমন সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটার সঙ্গে যা হল, তার শেষ দেখে ছাড়ব। দরকার পড়লে স্বাস্থ্য দফতরের সব মহলে যাব।’’

প্রসঙ্গত, গত বছরই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এসএনসিইউ-এর ওয়ার্মারে দুই সদ্যোজাতর পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় দু’জন নার্সকে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। গত বছর জুলাইয়ে বালুরঘাট হাসপাতালে আট দিনের এক শিশুর হাতে লাগানো স্যালাইনের চ্যানেল কাটতে গিয়ে তার আঙুল কেটে ফেলেছিলেন এক নার্স। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ডাফরিন সূত্রের খবর, বুধবার শিশুটিকে মেডিক্যালে রেফারের সময়ে লিখিত ভাবে নার্সের ভুল ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা জানানোয় ক্ষোভে ফেটে পড়েন নার্সরা। চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁদের জোর তর্কবিতর্ক বাধে। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানান, সদ্যোজাতর জীবন নিয়ে এই খেলা বরদাস্ত করা হবে না। লেখা প্রত্যাহারও করেননি তাঁরা। ডাফরিনের ডেপুটি নার্সিং সুপার এবং সুপার অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন