মনের আঁধার ঠেলে পঞ্জাবি বৌমা অতসী

বাপহারা মেয়ের মা-দাদাদের মনে খানিক ধন্দ ছিল! কোথাকার পঞ্জাবি ছেলে, তার ওপর আরবমুলুকে চাকরি করত, তোকে বিয়ের নাম করে ‘বেচে-টেচে’ দেবে না তো!

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৭ ০২:৫৬
Share:

পারিবারিক: স্বামী সন্দেশকুমার নাঙ্গলোর সঙ্গে অতসী কর্মকার। —নিজস্ব চিত্র।

উত্তর কলকাতার ঘুপচি গলির আদ্যিকালের বাড়িটায় কোনও দিন ফেরা হবে, আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন বছর পঁচিশের তরুণী।

Advertisement

এখন সেখানেই নোনাধরা দেওয়ালের চিলেকোঠা ঘরে রঙিন নতুন বৌয়ের লাল-নীল সংসার। জিন্স-টপে ফিটফাট অতসী কর্মকারের কপালে সিঁদুর ছাড়াও ঝিকোচ্ছে হাতের চুড়ির গোছা। জালন্ধরের শিখ বাড়ির বৌমার হাত-ভরা মাঙ্গলিক চুড়ি নিয়ে খেলছেন নতুন বর সন্দেশকুমার নাঙ্গলো। হেসে হিন্দিতে বললেন, ‘‘কলকাতায় আসার আগেই ‘আতাশি’র প্রতি আমার পুরো বিশ্বাস চলে এসেছিল। তখনই বিয়ে করব ঠিক করি।’’ একদা পাভলভের সরকারি মানসিক হাসপাতালে থাকতেন অতসী। ২০১৫-র গোড়ায় সেখান থেকে বেরনোর পরই ফেসবুকে সন্দেশের সঙ্গে আলাপ। বছর খানেক ফোন-চ্যাটের মেলামেশা। নিজের বিষয়ে সব কিছু খুলে বলেছিলেন অতসী। তাঁকে বিয়েতে রাজি করাতে সটান কলকাতায় চলে আসেন পঞ্জাবের যুবা সন্দেশ।

আরও পড়ুন: স্বামীকে মারার আগে মদ-মাংস

Advertisement

বাপহারা মেয়ের মা-দাদাদের মনে খানিক ধন্দ ছিল! কোথাকার পঞ্জাবি ছেলে, তার ওপর আরবমুলুকে চাকরি করত, তোকে বিয়ের নাম করে ‘বেচে-টেচে’ দেবে না তো! ছিপছিপে ফর্সা দোহারা তরুণ মুখোমুখি হতে সব সংশয়ের অবসান। ছেলের বাবাও পঞ্জাব থেকে ফোনে অতসীকে বললেন, বেবি তু আভি ইধার আ জা! গত বছর ১৯ জুন চার হাত এক হতে তাই দেরি হয়নি। ছেলের বাড়িই বাঙালি বৌমার বিয়ের দায়িত্ব নেয়।

মানসিক হাসপাতালের বন্দি জীবন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের দুনিয়াটাই যে জীবনের শেষ কথা নয় তখন বুঝতে শিখেছেন অতসী। আজকের আত্মবিশ্বাসী তরুণী বলেন, ‘‘মানসিক হাসপাতালটাকে অনেকেই মানুষ ছুড়ে ফেলার ধাপার মাঠ ভাবেন। আর খোঁজও নেন না। সুযোগ পেলে অনেকেই কিন্তু নতুন জীবন পেতে পারেন।’’ মনোরোগের চিকিৎসক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়রা সেই ভরসাটা অতসীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে ফেরার পরে জীবন তাঁকে দিয়েওছে দু’হাত ভরে। কিন্তু মানসিক হাসপাতালের অভিজ্ঞতাটাও ভুলতে চান না অতসী। কিছু দিন আগে বরকে নিয়ে পাভলভের প্রিয়জনেদের সঙ্গে দেখা করতে ফলের ঝুড়ি হাতে হাজির হয়েছিলেন তিনি। পুরনো বন্ধুরা অনেকেই বলেছেন, ‘‘তোর বর তো দারুণ হ্যান্ডসাম হয়েছে রে!’’

পেশায় পেট্রোল-ডিজেলের মেকানিক সন্দেশের সঙ্গে পঞ্জাবে শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন অতসী। এখন কিছু পারিবারিক কাজ সারতে ওঁরা কলেজ স্ট্রিটে অতসীর মায়ের বাড়িতে রয়েছেন। অতসীর মা-ও জামাইকে নিয়ে বিগলিত! ‘‘ছেলেটা খুব ভাল! জ্বরের সময়ে আমায় ভাত রেঁধে অবধি খাইয়েছে।’’ শান্তশিষ্ট বরকে সারা ক্ষণ ভাঙা-ভাঙা পঞ্জাবিতে ‘ও জি আ কর দেও, ও কর দেও’-করে টুকরো-টাকরা আবদারে মশগুল অতসী। আর শ্বশুরবাড়ির দুরন্ত লস্যি কত দিন চাখা হয়নি বলে খালি আফশোস করছেন। পঞ্জাবের একটি হাসপাতালে ইতিমধ্যে চাকরিও করছেন অতসী। তাঁর এই উজান ঠেলে আলোয় ফেরার গল্প নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করছেন ফিল্মস্কুলের শিক্ষক, এক পরিচালক।

কিছু দিনেই ফের বরের সঙ্গে পঞ্জাবে ফিরবেন অতসী। মানসিক হাসপাতালের পাঁচিল, বাপের বাড়ির গলি ছাড়িয়ে তাঁর সামনে আকাশে ডানা মেলার হাতছানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন