আজ ট্রেন চালিয়েই ছাড়ব! ‘খ্যাপা’র খেয়ালে হুলুস্থুলু বারাসত স্টেশনে

কী কুক্ষণেই যে নামতে গিয়েছিলেন গার্ডসাহেব! এমনিতে নামার কথা নয়। আর নামলেও গার্ডের কামরার দরজাটা তালাচাবি বন্ধ করে যাওয়ার কথা তাঁর। তা করেননি গার্ডসাহেব।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৪
Share:

সেই ট্রেন-খ্যাপা। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

কী কুক্ষণেই যে নামতে গিয়েছিলেন গার্ডসাহেব!

Advertisement

এমনিতে নামার কথা নয়। আর নামলেও গার্ডের কামরার দরজাটা তালাচাবি বন্ধ করে যাওয়ার কথা তাঁর। তা করেননি গার্ডসাহেব। শুক্রবার রাত ৯টা ৫০ নাগাদ বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল বারাসত স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই টুক করে নিজের কেবিন ছেড়ে নেমে পড়েছিলেন দরজাটা হাটখোলা করে রেখেই!

কেন নেমেছিলেন?

Advertisement

নিমপাতা খাওয়া মুখ করে গার্ডসাহেব বলছিলেন, ‘‘ব্যক্তিগত কাজ ছিল!’’ শুনে বারাসতের প্ল্যাটফর্মের হকার, ডেলি-প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছেন। তার পর বলছেন, ‘‘লোকটা কী করে মুখ ফুটে বলবে বলুন তো, যে বড্ড জোর হিসি পেয়ে গিয়েছিল! আর তা ছাড়া এমন গেরোয় পড়বে কে জানত!’’

নিজের কেবিনের বাইরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন গার্ডসাহেব। সঙ্গে জিআরপি, আরপিএফ, উৎসাহী প্যাসেঞ্জার, ভীতু প্যাসেঞ্জার, হকার— সব মিলিয়ে একটা বড় জটলা।

জাল ঘেরা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবিনের ভেতরে দাঁড়ানো লোকটাকে। পরনে সাধারণ টি-শার্ট-ট্রাউজার্স। সামনের প্যানেলের সুইচগুলো পটাপট টিপে চলেছে সে। বোঁ করে ঘুরিয়ে দিচ্ছে ছোট-বড় হ্যান্ডেল। মুখে আওয়াজ, ‘‘ভ্রুউউউউউউউউউউউম!’’ বাইরে আরপিএফ জওয়ান চেঁচালেন, ‘‘অ্যাই, নামবি কি না বল।’’ ভাঙা বাংলায় লোকটা বলল, ‘‘অনেক দিন ধরে তাক করে আছি। আজ ট্রেন চালিয়েই ছাড়ব..... ভ্রুউউউউউউউম।’’

দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিয়েছে লোকটা। নিরাপত্তার কথা ভেবেই লোকাল ট্রেনে মোটরম্যানের কেবিনের দরজা এমন ভাবে বানানো হয় যে, ভেতর থেকে এক বার লক করে দিলে সাধারণ লোকের পক্ষে তা বাইরে থেকে খোলা অসম্ভব। গার্ডসাহেব তাই হাত কামড়াচ্ছেন। তত ক্ষণে খবর শুনে ভিড় ট্রেন থেকে পটাপট নেমে পড়ছেন অনেকেই। লোকাল ট্রেনের গার্ডের কেবিন মানে তো চালকেরই কেবিন। বলা তো যায় না, যদি সত্যিই চালু হয়ে যায় ট্রেন! রেলরক্ষী বাহিনীর কেউ কেউ বলছিলেন, প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, কোনও জঙ্গি বোধহয় উঠে পড়েছে। এ যে মানসিক ভারসাম্যহীনের কাণ্ড, সেটা বুঝতেই লেগে যায় বেশ কিছুক্ষণ।

তার পর রীতিমতো কৌতুক-নাটিকা! পুলিশ বাইরে থেকে বলছে, ‘‘মার খাবি?’’ সে উত্তর দিচ্ছে, ‘‘আমি নামলে তো মারবি!’’ ভয় দেখিয়ে কাজ না হওয়ায় তাকে এ বার বাবা-বাছা করে বোঝানোর একটা চেষ্টা করলেন হকারদের কয়েক জন। প্রথমে একশো টাকা, তার পর পাঁচশো টাকার নোট দোলানো হল। ভবি ভোলার নয়! শেষ পর্যন্ত আর উপায় না দেখে আরপিএফ নিয়ে এল তাদের মিস্ত্রিকে। বাইরে থেকে দরজার লকটাই ভেঙে ফেললেন তিনি।

দরজা খোলা মাত্রই একপ্রস্ত উত্তম-মধ্যমের তোড়জোড় শুরু হচ্ছিল। সেটা রুখলেন যাত্রীরাই। বললেন, ‘‘একটা পাগলকে পেটাবেন কেন? গার্ডকে জিজ্ঞেস করুন উনি কেন নেমেছিলেন?’’ দু-এক জনের অভিযোগ, প্রাকৃতিক কাজ সেরে গার্ডকে প্ল্যাটফর্মে চা খেতেও নাকি দেখেছেন তাঁরা!

এ নিয়ে বারাসতের স্টেশন মাস্টার প্রদীপ পাল মুখ খুলতে চাননি। তবে রেল-সূত্র বলছে, এখন বিস্তর বিশ্লেষণ বাকি। গার্ড কেন নেমেছিলেন, কেন কেবিন লক করেননি, নামার আগে ওয়াকিটকি-তে চালককে জানিয়েছিলেন কি না এবং রেল রক্ষী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে কেবিনে একটা উটকো লোক উঠে পড়ল কী করে— এ সবেরই তদন্ত হবে।

মোটের উপর মিনিট কুড়ি-পঁচিশের ঘটনা। কিন্তু যাত্রায় বাধা পড়ায় ওই লোকালের প্যাসেঞ্জারদের অনেকেই উল্টোদিকের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আর উৎকলবাসী ওই ট্রেন-খ্যাপাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিয়ালদহ জিআরপি-তে। খবর ছড়িয়ে পড়ায় তাকে দেখতে বারাসত স্টেশনেই বড্ড বেশি ভিড় হয়ে যাচ্ছিল কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন