দেওয়ালে দেওয়ালে দু’দলের প্রতীক এক সঙ্গে এঁকে যৌথ প্রচারে নেমে পড়েছেন বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। দেওয়ালের লিখন পড়ে নিয়েই বোঝাপড়ার পথে উদ্বেগ দূর করতে তৎপর হলেন সিপিএম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব!
আসন-রফার সূত্র বার করার মরিয়া চেষ্টার পাশাপাশিই স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। কংগ্রেসের তরফে ৭৫টি আসনের তালিকা ঘোষণা করতে গিয়ে অধীর চৌধুরী মঙ্গলবার বলেছিলেন, প্রয়োজনে কিছু আসনে বামেদের সঙ্গে তাঁদের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ হবে। কংগ্রেসের তরফে এমন ঘোষণায় বাম শিবিরে যেমন কিছু উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল, তেমনই আবার বিমান বসুর কিছু মন্তব্যে রুষ্ট হয়েছিল কংগ্রেস শিবির। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে না দেওয়ার লক্ষ্যেই এর পরে উদ্যোগী হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকাম্ত মিশ্র ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁদের হস্তক্ষেপেই সিপিএম বুধবার প্রকাশ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, যত বেশি সম্ভব আসনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির তরফে এক জন প্রার্থী রাখার জন্যই সবর্তো ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।
যৌথ প্রচারের কোনও প্রশ্ন নেই, এ কথা জানাতে গিয়েই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমানবাবু ‘জোট-ঘোঁট’ শীর্ষক এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যাতে প্রবল প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ওই মন্তব্যকে বিঁধে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। আবার এরই পাশাপাশি সাধারণ বাম কর্মী-সমর্থকদের তরফে সোশ্যাল সাইটে বিরূপ সমালোচনার ঝড় আছ়ড়ে পড়ছিল বিমানবাবুর মন্তব্যের বিরুদ্ধে! এরই প্রেক্ষিতে এ দিন আলিমুদ্দিনে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের পরে আসরে নামানো হয় সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিমকে। যিনি সাফ বলেন, ‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য! পার্টি অফিসে বসে বা কনভেনশন করে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার জায়গা এখন নেই। আক্রান্ত মানুষ পথে নেমেছেন। পথে নেমেই পথ চিনতে হবে।’’ সেলিমের এই বক্তব্যের সঙ্গে অধীরের আগের দিনের বক্তব্যের বিশেষ ফারাক নেই।
বস্তুত, বৃহত্তর ঐক্যের জন্য আলিমুদ্দিনের সদিচ্ছা বোঝাতে এক ধাপ এগিয়ে সেলিম এ দিন আরও বলেছেন, ‘‘তৃণমূলকে হারাতে এবং বিজেপি-কে রুখতে সব কিছু করতে আমরা তৈরি! একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’’ নানা এলাকায় একসঙ্গে হাত ও কাস্তে-হাতুড়ি এঁকে প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে প্রশ্নের মুখেই আগের দিন ঈষৎ মেজাজ হারিয়েছিলেন বিমানবাবু। সেলিম কিন্তু এ দিন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, ‘‘আমরা দেখব যাতে, এক বিধানসভায় (আসন) দু’টো প্রতীক আঁকতে না হয়!’’ অর্থাৎ চেষ্টা হবে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার।
তবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য এটাও বলে রাখছেন, ‘‘হাতে-গোনা দু-একটা আসনে নিয়ন্ত্রিত ভাবে এবং সমন্বয়ের ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হবে। তৃণমূলকে কোণঠাসা করা এবং একই সঙ্গে আমাদের দলীয় অবস্থান ঠিক রাখতে এটা হয়তো রাখতে হবে।’’
রাজনৈতিক সদিচ্ছার বার্তা স্পষ্ট করে দেওয়ার আগেই অবশ্য শুরু হয়েছিল নতুন করে দৌত্যের প্রয়াস। কংগ্রেসের আসন তালিকা জানাতে গিয়ে অধীরের ঘোষণায় বাম শিবিরে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কংগ্রেস আসন নিয়ে কথার খেলাপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছিল বাম মহল থেকে। আবার প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশও বিষয়টিতে সন্তুষ্ট ছিল না। নির্দিষ্ট তালিকা ধরে না এগিয়ে কেন যখন তখন যেমন তেমন আসন দাবি করা হবে, তা নিয়ে দলীয় মহলে ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অসন্তোষ ব্যক্ত করছিলেন কংগ্রেস নেতাদের কেউ কেউ। তার পরেই এআইসিসি-র সম্মতিতে ময়দানে নামানো হয় প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি সোমেন মিত্রকে। তাঁর দৌত্যে আসনের জট কিছুটা ছাড়ানো গিয়েছে বলেই দুই শিবির সূত্রের খবর। কিছু আসন নিয়ে টানাপড়েন এখনও আছে। তবে সেগুলির ক্ষেত্রে মূলত বাম শরিকদের রাজি করাতে হবে আলিমুদ্দিনকে। প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘দু’দলই নিজেরা লড়বে বলে যে সব আসনের কথা বলেছে, তার মধ্যে কিছু অদল-বদলের কথা হচ্ছে। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর বা কলকাতা শহরের আসনও রয়েছে।’’
কংগ্রেস সূত্রের খবর, পুরভোটে তৃণমূলের পরেশ পালকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দেওয়া প্রকাশ উপাধ্যায়ের জন্য বেলেঘাটা আসনটি সিপিএমের কাছ থেকে নিয়ে তাদের জোড়াসাঁকো ছেড়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে। আবার মুর্শিদাবাদে ডোমকল আসন থেকে সিপিএম প্রার্থী আনিসুর রহমানকে সরিয়ে নিয়ে সাগরদীঘিতে দাঁড় করানোর কথাবার্তা হচ্ছে। সিপিএমও আবার শরিকদের কাছে আর্জি জানাচ্ছে, তাদের আসনের বিষয়ে ফের ভেবে দেখতে। এই তৎপরতার মধ্যেই সমীর পূততুণ্ড, সুভাষ বসুদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে পিডিএসকে কাকদ্বীপ আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন বিমানবাবু। দক্ষিণ ২৪ পরগনারই মগরাহাট পশ্চিম আসনটি ছাড়া হয়েছে ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা রইসুদ্দিনের জন্য। ওই দল অবশ্য আরও ১৫টি আসনে নিজেদের মতো করে লড়বে। কংগ্রেসের নাম না-করেই সেলিম এ দিন বলেছেন, ‘‘এই নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, তৃণমূলের পাশে কেউ নেই! এটা ধারাবাহিক কাহিনি। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে!’’
দ্বিতীয় দফার জন্য আরও প্রায় ৪০ জন প্রার্থীর নাম এ দিন ঠিক করা হয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে। বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে আজ, বৃহস্পতিবার আর এক দফা তালিকা ঘোষণা হতে পারে।