মিডডে’র পাতেই ভাবটা ঘন হয়ে উঠল

হাঁ করে কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে রইল গবার দিকে। তারপর, মিহি গলায় বললে, ‘‘আমার পাতের চর্বিটা নিবি?’’ গবা হাত বাড়িয়ে দেয়। 

Advertisement

ছন্দক বন্দ্যোপাধ্যায়

বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:১৪
Share:

অ্যাই গবা, বল্‌ তো এতক্ষণ কী পড়াচ্ছিলুম?

Advertisement

বাংলার স্যর অসিতবাবুর গম্ভীর ডাকে সম্বিৎ ফিরল গোবিন্দর। বৈশাখের তপ্ত দুপুর। পাশের বাগানে আম গাছে একটা কুবোপাখি একটানা ডেকে চলেছে। টিফিনের আগের পিরিয়ড চলছে। অসিতবাবু মন দিয়ে ‘বাঁধরক্ষা’ গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছিলেন। গোটা ক্লাস মন দিয়ে তা শুনছিল। গবার অবশ্য সেদিকে মন নেই। আজ ওদের স্কুলে মিডডে মিলের মেনুতে মাংস। এক মাস পর মাংস খাবে ও। এই সময় সুদূর নেদারল্যান্ডসের কোথাকার, কে হান্স, তার কথা ও শুনতে যাবেই বা কেন! রান্নাঘর থেকে মাংস রান্নার সুবাস নাকে এসে বারবার ধাক্কা মারছিল ওর। সেই গন্ধে একেবারে কুপোকাত। উফ্‌! কতক্ষণে যে টিফিন হবে! তর সইছিল না ক্লাস ফাইভের ছাত্রের। বারবার আড়চোখে কোনাকুনি হেডস্যরের ঘরের ঘড়িটায় চোখ চলে যাচ্ছিল ওর। সকাল থেকে কয়েকশো বার দেখা হয়ে গিয়েছে। এমন সময় স্যরের বজ্রকণ্ঠ সব সুর-তাল কেটে দিল। স্যরের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল গবা। এক সময়ে মাথাটা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কী হতে চলেছে, সেটাই আন্দাজ করার চেষ্টা করল সে। আড়চোখে একবার দেখে নিল স্যরকে। অসিতবাবু ওর দিকেই এগিয়ে আসছেন। গবা জানে এবার কী হবে। স্যর আসবেন, তারপর আচ্ছা করে ওর কানটা মুচড়ে দেবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন তা হল না, অবাক হল ও। গবা দেখল, স্যর ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছেন, ‘‘হ্যাঁরে, মাংস খেতে খুব ভালবাসিস, না!’’

টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই এক ছুটে রান্নাঘরের দরজার সামনের আসনটায় ঝাঁপিয়ে পড়ল গবা। গত ক’মাসে রান্নার মাসির ধাঁচ বোঝা হয়ে গিয়েছে ওর। গবা দেখেছে, তেলচিটে অ্যালুমিনিয়ামের বালতি থেকে মাসি হাতায় করে প্রথমবার যে মাংসগুলো তুলে আনে, সেগুলোই সেরা। অমন ভাল পিস তারপর আর মেলে না। রান্নাঘরের সামনে প্রথম দু’-তিনজনের মধ্যে বসতে পারলে মাংসের বড় পিস আর মেটেটা বাঁধা। গত মাসে বেশ ঠকতে হয়েছিল তাকে। দেরি করায় রান্নাঘরের সামনের আসনটা ও পায়নি। কিছুটা দূরে বসতে হয়েছিল। সেবার গুঁড়ো হাড় আর চর্বি ছাড়া কিছুই জোটেনি। আজ কিছুতেই তা হতে দেওয়া যাবে না। সকাল থেকে সেই জন্যই তো এত সাধ্যসাধনা। আজ সবার আগে ও স্কুলে এসেছে। ক্লাসে দরজার ঠিক পাশের বেঞ্চটায় বসেছে, যাতে টিফিনের ঘণ্টা পড়লে এক ছুটে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসতে পারে। তারপর চারটে পিরিয়ড একভাবে শুধু টিফিনের ঘণ্টার অপেক্ষা করে গিয়েছে সে।

Advertisement

খাবার লাইনটা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ইংরেজি ‘ইউ’ এর মতো বেঁকে আবার গবাদের দিকেই চলে এসেছিল। গবা আর ওর বন্ধুরা বসে বসে রান্নার মাসির আসার অপেক্ষা করছিল। গবা দেখল, ওর উল্টোদিকে বসে ইলিয়াস বলে সেই ছেলেটা। স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে ও। গায়ে তেলচিটে জামা। মাথায় যে কতদিন তেল পড়েনি, কে জানে! জুলজুল করে রান্নাঘরের দিকে দেখছিল ইলিয়াস। গবার সঙ্গে এ ক’দিনে বিশেষ কথা হয়নি তার। একবারই পেন্সিল কাটার জন্য গবা ওর কাছে কল চেয়েছিল। ব্যস, ওই একবারই। এই সময়ে রান্নার মাসি সুলতাকে বালতি হাতে এগিয়ে

আসতে দেখল ওরা। মাংসভর্তি হাতাটা মাসি পাতে উপুড় করতেই চোখ চকচক করে উঠল গবার। দেখল, যে পিসগুলো ও পছন্দ করে, ঠিক সেগুলোই সুলতা দিয়েছে। পাঁঠার একটা মেটেও সে পেয়েছে। রান্নার মাসি কি ম্যাজিক জানে! মনে মনে ভাবল ও। সুলতার দিকে কৃতজ্ঞতার আলগা চাহনি ছুড়ে দিল গবা। হাতা উপুড় করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সুলতা, একবার বাঁদিক, একবার ডানদিক। সুলতা যেতে পাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় গবার চোখ গেল ইলিয়াসের পাতে। বেচারা একেবারে ঠকে গিয়েছে। কয়েকটা চর্বি ছাড়া কিছুই পায়নি। ওর জন্য খারাপ লাগছিল গবার। ইলিয়াসের সামনে ওর নিজেকে ‘অপরাধী’ বলে মনে হল। একটু ভেবে নিল গবা। তারপর নিজের সবচেয়ে পছন্দের মাংসের দুটো পিস ইলিয়াসকে দিতে গেল ও। একবার অস্ফূটে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও হাত গুটিয়ে নিল ইলিয়াস। হাঁ করে কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে রইল গবার দিকে। তারপর, মিহি গলায় বললে, ‘‘আমার পাতের চর্বিটা নিবি?’’ গবা হাত বাড়িয়ে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন