সেরে ওঠার মুখে মরণকামড়, এ কোন ডেঙ্গি

ডেঙ্গি আক্রান্ত মেয়েটি ক্রমশ সেরে উঠছিল। মঙ্গলবার সকালেও সকলের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলছিল সে। দুপুরে হাসপাতালের শয্যায় বসে ভাতও খেয়েছিল। এর পর আচমকাই তার খিঁচুনি শুরু হয়। বমি হয় দু’বার। কয়েক মিনিটের মধ্যে সংজ্ঞা হারায় সে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৪
Share:

ডেঙ্গি আক্রান্ত মেয়েটি ক্রমশ সেরে উঠছিল। মঙ্গলবার সকালেও সকলের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলছিল সে। দুপুরে হাসপাতালের শয্যায় বসে ভাতও খেয়েছিল। এর পর আচমকাই তার খিঁচুনি শুরু হয়। বমি হয় দু’বার। কয়েক মিনিটের মধ্যে সংজ্ঞা হারায় সে। সেই সংজ্ঞা আর ফেরেনি। ভেন্টিলেশনে দেওয়ার পরেও অবস্থার কোনও উন্নতি তো হয়ইনি, বরং খুব দ্রুত সমস্ত মাপকাঠিই খারাপ হতে শুরু করে। সন্ধ্যায় মারা যায় বেহালার বাসিন্দা ন’বছরের অহর্নিশা ঘোষ।

Advertisement

কলকাতার ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর চিকিৎসকেরা এই মৃত্যুকে ঘিরে তাঁদের হতভম্ব ভাবটা এখনও কাটাতে পারছেন না। ওই দিন সকাল পর্যন্তও যার তেমন কোনও শারীরিক জটিলতা ছিল না, প্লেটলেট ছিল ৮০ হাজার, আচমকা কী হল তার, তা অনেক ভেবেও বার করতে পারছেন না তাঁরা। চিকিৎসকদের বক্তব্য, নানা চেহারায়, নানা উপসর্গে ডেঙ্গি এ বার বহু ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত করে তুলছে। যে রোগীর ক্ষেত্রে এক সময়ে মনে হচ্ছে সব ঠিক আছে, পরের মুহূর্তেই তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটছে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে অহর্নিশার ক্ষেত্রে। ২৬ তারিখ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে। তার পর থেকে জ্বরটা পুরো কমছিল না, কিন্তু অন্য আর কিছু অসুবিধেও ছিল না। বরং সামগ্রিক ভাবে তার শারীরিক উন্নতিই হচ্ছিল।

ইনস্টিটিউট-এর চিকিৎসক প্রভাস প্রসূন গিরি বলেন, ‘‘আমরা দু’টি বিষয় সন্দেহ করছি। ডেঙ্গি থেকে হয়তো মস্তিষ্কে সংক্রমণ হয়ে গিয়েছিল, অর্থাৎ ডেঙ্গি এনসেফ্যালাইটিস। নয়তো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। কিন্তু প্লেটলেট ১০ হাজারের নীচে না নামলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ সাধারণ ভাবে হয় না। এ ক্ষেত্রে আসল কারণ নিয়ে আমরাও বিভ্রান্ত।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ বারে ডেঙ্গির যা রূপ দেখছি, তা আগে কখনও দেখিনি। এই উপসর্গগুলো নিয়েই একটা গোটা বই লিখে
ফেলা যায়।’’

Advertisement

বস্তুত, এই কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছেন বিভিন্ন ডাক্তার। শিশুরোগ চিকিৎসক তথা ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের কাছেও ডেঙ্গি নিয়ে রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে এ বার। আগের বছরগুলির চেয়ে এ বারে রোগের চেহারা-চরিত্র সবই আলাদা। নভেম্বর মাস পড়ে গেল, রোগ কমার কোনও লক্ষণ নেই, উপরন্তু বেড়ে চলেছে।’’

একই অভিমত পতঙ্গবিদ অমিয় হাটির। তিনিও জানিয়েছেন, এ বারে ডেঙ্গির ভয়াবহতা অন্য বারের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ‘‘কোনও ভাবেই যেন আসল জায়গায় কব্জা করা যাচ্ছে না রোগটাকে’’— মত অমিয়বাবুর। তিনি বলেন, ‘‘জ্বর আসার পরে প্রথম কয়েকটা দিন সব ঠিক থাকছে। পঞ্চম থেকে সপ্তম দিনে হঠাৎই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে তাই এ বার নজরদারি দরকার। পাঁচ দিনের পর থেকে তো খুব বেশি করে নজর রাখা জরুরি।’’

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে ডেঙ্গির আলাদা কোনও চিকিৎসা নেই। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল আর পর্যাপ্ত ফ্লুইড, এটাই মূল চিকিৎসা। এ ছাড়া প্লেটলেট খুব কমে গেলে প্লেটলেট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। প্লেটলেট না কমলে সাধারণ ভাবে বাড়িতেই রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, প্লেটলেট তেমন না কমলেও আচমকাই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে যাচ্ছে। আর তাই রোগীকে বাড়িতে রাখার ঝুঁকি নিচ্ছেন না অনেকেই।

কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতাল ছেয়ে রয়েছে ডেঙ্গি রোগীতে। আশপাশের জেলাগুলিরও একই অবস্থা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক একটি ব্লক থেকে আগে মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ জনের জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসত। ইদানীং আসছে ১৫০০-এরও বেশি। জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, এর মধ্যে একটা বড় অংশই ডেঙ্গি আক্রান্ত। এ দিন কলকাতা পুরসভায় জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের সিটি লেভেল ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং কমিটির বৈঠক ছিল। সেখানেও ডেঙ্গির বিষয়টি সামনে আসে। পরে কমিটির চেয়ারম্যান সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কলকাতায় এখন পুরসভার সাতটি ডেঙ্গি নির্ণয় কেন্দ্র আছে। আরও ১০টি নতুন কেন্দ্র তৈরি হবে।

তা হলে কি শেষ পর্যন্ত প্রশাসন মেনে নিচ্ছে ডেঙ্গি পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা?

রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, বিষয়টা তেমন নয়। অন্য বারের চেয়ে এ বার আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বেশি। তবে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে এমন নয়। আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পুরোটাই কমে যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন