মন্দারমণির সৈকতের উপর দিয়ে এভাবেই তৈরি হয়েছে চ্যানেল রোড। সোহম গুহর তোলা ছবি।
নামেই আলাদা রাস্তা। আদতে সৈকতেরই একটা অংশ ধরে চলছে গাড়ি যাতায়াত। মন্দারমণির সৈকতে গাড়ি চলাচলের ফের নিষেধাজ্ঞা জারির পর এটাই নতুন ছবি।
মন্দারমণির সৈকতে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। কিন্তু নিয়মের ফাঁক গলে পুলিশ-প্রশাসনকে বু়ড়ো আঙুল দেখিয়ে বরাবরই সৈকত দিয়েই চলেছে গাড়ি। আর তার মাসুল দিয়ে দুর্ঘটনাও কম ঘটেনি। তার সাম্প্রতিকতম নির্দশন সৈকতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় তিন তরুণের মৃত্যু। যতবারই কোনও দুর্ঘটনা ঘটে ততবারই দিন কয়েক পুলিশি নজরদারি বাড়ে, সৈকতে গাড়ি চালানোর বিষয়ে কড়া হয় প্রশাসন। আবার কয়েকটা দিন পেরোলেই যে কে সেই।
তবে গত ২১ অগস্টের প্রাণঘাতী সেই দুর্ঘটনার পর ছবিটা কিছুটা বদলেছে। চ্যানেল রোড তৈরি করে চলাচল করানো হচ্ছে পর্যটকদের গাড়ি ও স্থানীয় ট্রেকার। পুলিশ জানিয়েছে, সৈকতের ধারে বাঁশের বেড়া করে ৫ হাজার ফুট চ্যানেল রোড তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় ট্রেকার ও পর্যটকদের হোটেলে যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে এই রাস্তা। সোমবার মন্দারমণিতে গিয়ে দেখা গেল সৈকতের ধারে চ্যানেল রোডের বাঁশের বেড়া দিয়েই চলছে গাড়ি। এই রাস্তা সৈকতেরই একটা অংশ। শুধুমাত্র বাঁশের খুঁটি পুঁতে একটা পৃথক রাস্তা বের করা হয়েছে। জানা গিয়েছে আর দেড় কিলোমিটার বাকি রয়েছে মূল সড়কের কাজ। সেই কাজ শেষ হলেই এই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। পুলিশি নজরদারিও রয়েছে জোরদার। কোনও হোটেলে বুকিংয়ের স্লিপ দেখালে তবেই মিলবে ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলাচলের ছাড়পত্র।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এটা তো কোনও নতুন রাস্তা নয়। সৈকতের একটা অংশ ঘিরে চলছে যাতায়াত। এতেও তো ক্ষতিই হচ্ছে সৈকতের। আর এই বালির রাস্তায় যাতায়াত নিরাপদই বা কতটুকু? উত্তর মেলেনি। তবে, কাঁথির মহকুমাশাসক রিনা নিরঞ্জন বলেন, ‘‘মন্দারমণিতে সৈকতের ধারে বিকল্প রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চ্যানেল রোড দিয়েই ট্রেকার ও পর্যটকদের গাড়ি যাতায়াত করবে। সৈকতে কোনও গাড়ি নামতে দেওয়া হবে না। রাস্তা তৈরির কাজ শেষ হলে ওই রাস্তা দিয়েই যান চলাচল করবে। তখন চ্যানেল রোডও বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
সৈকতে নামার আগেই লাল রঙের কালিতে বড় পোস্টারে লেখা রয়েছে সৈকতে সমস্ত রকম যান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই নির্দেশ সার। নজরে পড়ল সৈকতে বিচ বাইকের দাপাদাপিও।
গত বছর ২১ জুন মন্দারমণি সৈকতেই অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের প্যারাসেলিং করতে গিয়ে প্যারাস্যুটের কাপড় সৈকতের বাতিস্তম্ভে আটকে মৃত্যু হয়েছিল এক পর্যটকের। এ নিয়ে শোরগোলের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্দারমণি-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের সৈকত কেন্দ্রগুলিতে যাবতীয় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস সংস্থার কর্ণধারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হলেও তার টিকিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ। আর সেই নিষেধাজ্ঞার মাস খানেক পর থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। এমনকী যখন আলাদা রাস্তা গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে প্রশাসন, তখনও সৈকত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিচ বাইক। পুলিশের দাবি, ‘‘হাজারিবাগের একটি সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন দফতরের অনুমোদন নিয়েই সৈকতে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় পর্যটন দফতরের অনুমোদন থাকায় করার কিছু নেই।”
সৈকতে গাড়ি চালানোকে অবৈধ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলে দাবি করেছেন রাজ্যের গবেষক সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও বনবিদ্যা বিভাগের প্রধান ও গবেষক অমলকুমার মণ্ডল বলেন, “মন্দারমণি সৈকতের উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সৈকতে যান চলাচল নিষিদ্ধ করেও কেন যে প্রশাসন বিচ বাইককে আটকাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’’ রাজ্যের বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়েরও কথায়, ‘‘এমন পরিস্থিতিতেয় পর্যটন দফতর যদি সৈকতে বিচ বাইক চালানোর অনুমোদন দিয়ে থাকে তাহলে তারা উপকূল তট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অবৈধ কাজ করেছেন।’’