শুকনো করা হচ্ছে মাদুরকাঠি (বাঁ দিকে)। নিজেদের শিল্পকর্ম দেখাচ্ছেন শিল্পীরা (ডান দিকে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
মাদুর শিল্পের উপরই নির্ভর করে রয়েছে একটা গোটা ব্লকের জীব-জীবিকা। অথচ লোকশ্রুতি ছাড়া এই কুটির শিল্পের সৃষ্টির উৎসের সন্ধান মেলে না কোত্থাও। এমনকী বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রমশ কমে যাচ্ছে কাজের প্রতি শিল্পীদের আকর্ষণ। ফলে ভবিষ্যৎ যে তেমন উজ্জ্বল নয়, তাও স্পষ্ট।
একটা সময় মানুষের চাহিদা নির্ভর করেই রোজগারের পথ হিসাবে মাদুর তৈরিকে বেছে নিয়েছিলেন সবং ব্লকের মানুষ। কিন্তু এখন সেই চাহিদা কমেছে। ফলে নিত্য ব্যবহার্য মাদুরের উৎপাদনও কমছে। শিল্পীদের অভিযোগ বাজার ছেয়ে গিয়েছে অল্প দামের মাদুরে। তাই ধুঁকছে হাতে বোনা মাদুর শিল্প। বাধ্য হয়েই শিল্প বাঁচিয়ে রেখে বাজার ধরতে শৌখিন মাদুর তৈরিতে মন দিচ্ছেন কারিগররা। এমনকী মাদুরের বদলে মাদুর কাঠি দিয়ে অন্য জিনিস তৈরি করে বাজারে টিঁকে থাকতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু তাতে তেমন লাভ নেই, তা শিল্পীরা জানান স্পষ্ট। উঠে আসে সরকারি উদাসীনতার অভিযোগও।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, মাদুর তৈরির ইতিহাস ধরা আছে গল্প কথায়। প্রায় চারশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সবংয়ে বিখ্যাত এই হস্তশিল্প। একসময়ে শয্যা হিসাবে ব্যবহার হত হেঁসাটি ঘাস। তাকে বলা হত হেঁস। বেশ মোটা ঘাসের হওয়ায় বেশিদিন ব্যবহার করাও যেত না হেঁস। সেই সময়ে সবংয়ের মোহার এলাকায় বরদার কাছে একটি পুকুরের শেওলা থেকে একপ্রকার মোটা ঘাস বের হতে দেখা যায়। কেউ কেউ সেই মোটা ঘাস দিয়ে নতুন ভাবে বুনতে শুরু করেন শয্যা। সেই থেকেই শুরু মাদুর।
প্রথম দিকে মোটা কাঠি দড়ি দিয়ে বেঁধে মাদুর তৈরি হত। ‘এককাঠি’র সেই মাদুরের এখন আধুনিকীকরণ হয়েছে। চেনা এককাঠি মাদুর থেকে দুই কাঠির মাদুর, মজলন্দ মাদুর, ফোল্ডিং মাদুর তৈরি হচ্ছে সবংয়ের ঘরে-ঘরে। সার্তা, বুড়াল, মোহার, বিষ্ণুপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাদুর কাঠির চাষ দেখলে বোঝা যায় বেঁচে আছে শিল্প। আর এই বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসটা পুরোটাই তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে, জানান শিল্পীরাই।
বছর চল্লিশ আগেও সবংয়ের মাদুরের শিল্প রমরমা ছচিল। গ্রীষ্মকালে মাদুরের আরাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাজ্যের ছাড়িয়ে দেশের নানা এলাকায়। তবে অর্থাভাব তখনও ছিল। ঋণের অভাবে পিছিয়ে পড়ছিলেন শিল্পীরা। ১৯৮২সালে বিধায়ক মানস ভুঁইয়ায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে উপহার দিয়েছিলেন দু’টি মজলন্দি মাদুর। সে শিল্প দেখে অবাক ইন্দিরা গাঁধী বেশ কিছু ব্যাঙ্কের লাইসেন্স দিয়েছিলেন শুধু মাদুর শিল্পীদের সাহায্যের জন্য। ১৯৮৬সালের বন্যার কথা আজও মনে রেখেছেন সবংবাসী। প্রবল বন্যা সত্ত্বেও ব্যাঙ্ক ঋণের বেশিটাই শোধ করেছিলেন শিল্পীরা।
আগে হাতেই বোনা হত সাধারণ ও মজলন্দ মাদুর। এখন অবশ্য হস্তচালিত যন্ত্রের সাহায্যে বোনা হয় মাদুর। মোটা কাঠি ব্যবহার হয় সাধারণত মাটিতে পাতার মাদুরের ক্ষেত্রে। এখন তার দাম ৫০০টাকার মধ্যেই। তবে মজলন্দ মাদুরের দাম ৩ থেকে ২০হাজার টাকা পর্যন্ত। দু’জন শিল্পীর ১২থেকে ৫০দিনের মতো সময় লাগে একটি মজলন্দ মাদুর বুনতে। একটি কাঠিকে দাঁত দিয়ে সরু করে কেটে সুক্ষ্মভাবে বোনা হয় রবীন্দ্রনাথ থেকে রাধাকৃষ্ণ, বড়দিন থেকে ইদের ছবি।
সার্তা গ্রামের ঘরে ঘরে মাদুর শিল্পী। তাঁরা প্রায় সাত পুরুষ ধরে মাদুর বুনছেন। সেই গ্রামেরই রাজ্য পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী অখিল জানা বলেন, “এখন মজলন্দি মাদুরের চাহিদা রয়েছে। তবে দামের জন্য কেউ নিতে চায় না। সরকারি ভর্তুকি তো পাই না, ফলে কম দামে বিক্রি করতে পারি না।’’এই গ্রাম থেকেই জাতীয় পুরস্কার পেয়ছেন বহু শিল্পী। পুষ্পরানি জানা, অলোক জানা, মিঠু জানা—তালিকাটা যত বড়, জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ততখানি নয়। তাঁদের কথায় স্পষ্ট এই পেশা এখন সরকারি সাহায্যের অভাবে ধুঁকছে। কম দামী প্লাস্টিক মাদুর ও চেন্নাইয়ের সিন্থেটিক মাদুর বাজার গ্রাস করছে। তবে এখন মাদুর কাঠি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যাগ, টেবিল ম্যাট, মোবাইল কভারের মতো নানা নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।
সরকারি সাহায্য বলতে কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। হাতের কাজ গোছাতে গোছাতে অখিলবাবু বলেন, “২০১১-১২সালে মজলন্দ ক্লাস্টার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল ১০শতাংশ অর্থ শিল্পী দেবে। বাকিটা রাজ্য ও কেন্দ্র। কিছু শিল্পী একসঙ্গে কিছুটা এগোতে পারত। কিছুই হল না।” বছর কুড়ি আগেও ভিন রাজ্যে মাদুরের পাইকারি বিক্রি জনপ্রিয় ছিল। সবং, বেলকি, দশগ্রাম ও মোহার হাটে মাদুর বিক্রি ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন শুধুই মন্দা। ব্লকের একমাত্র তেমাথানি মোড়ে একটি মাদুরের দোকান রয়েছে। মালিক তারাপদ সামন্তর আক্ষেপ বলেন, “একটা সাড়ে তিন ফুট চওড়া মাদ্রাজি মাদুর ৭৫টাকায় বিক্রি হয়। একই মাপের সবংয়ের কাঠির মাদুর ২০০টাকা। ব্যবসার স্বার্থে মাদ্রাজি মাদুরই রাখতে হয়।’’
এ দিকে সরকারি উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক চাপান-উতোর যথেষ্ট। বাম আমল থেকেই এই শিল্প কদর পায়নি বলে অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। তাঁদের দাবি, বিধায়ক হিসেবে মানস ভুঁইয়া এই শিল্প বাঁচাতে নানা প্রয়াস চালালেও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, “খড়্গপুরে ৬কোটি টাকায় বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে জমি কিনেছিলাম। কিন্তু সরকার তা নিয়ে ভাবছে না। আমি বিভাগীয় মন্ত্রীকে এ কথা জানিয়েছি।”
যদিও প্রাকৃতিক তন্তুজ মিশনের অধীনে রাজ্য সরকার মাদুর হাব গড়ায় উদ্যোগী হয়েছে বলে দাবি তৃণমূলের। জেলা ক্ষুদ্রশিল্পের কর্মাধ্যক্ষ অমূল্য মাইতি বলেন, “কর্মতীর্থ নামে একটি মাদুর হাব গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রুইনানে জমি সংক্রান্ত সমস্যা মিটে গেলেই ওই হাব নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হবে।’’