প্রচারেও হুঁশ নেই, আস্থা অটুট গুণিনে

পারিবারিক  সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে প্রথমে শঙ্করীকে ডেবরার লোয়াদায় ও সোমবার সকালে সবংয়ের তেমাথানির এক গুণিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচী

নারায়ণগড় শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৭ ০২:৩১
Share:

গুণিনে বিশ্বাস নেই তাঁর। যাবতীয় সংস্কার ঝেড়ে ফেলে আশা কর্মী হিসেবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই তাঁর ব্রত। যদিও নারায়ণগড়ের মকরামপুর পঞ্চায়েতের অভিরামপুরের বাসিন্দা শঙ্করী সিংহ বেরার বাবা গুণিন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেদেরও গুণিনের উপর অগাধ আস্থা। অসুস্থ অবস্থায় শঙ্করীদেবী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে গুণিনের কাছে নিয়ে যান পরিজনেরা। জ্ঞান না থাকায় অবশ্য প্রতিবাদ করতে পারেননি তিনি। এই ঘটনায় ফের প্রমাণ হল, সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চললেও সংস্কারের অচলায়তন আজও অটুট।

Advertisement

বছর বত্রিশের শঙ্করীদেবী দিন কয়েক আগে জ্বরে আক্রান্ত হন। এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকায় প্রথমে তাঁকে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শনিবার তাঁকে রেফার করা হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কলকাতায় চিকিৎসা করাবেন বলে ওই রাতেই হাসপাতাল থেকে তাঁকে নিয়ে যান পরিজনেরা। এরপর ওই আশাকর্মীকে নিয়ে যাওয়া হয় ডেবরার এক গুণিনের কাছে। অসুস্থ ওই মহিলার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দাবি, অশরীরীর ‘হাওয়া লাগায়’ অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন শঙ্করী। গুণিনের ঝাড়ফুঁকের পরে ফের তিনি খাওয়া-দাওয়া শুরু করেছেন। রবিবার গোটা ঘটনার কথা জানতে পারেন জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা। তারপর অনেক বুঝিয়ে সোমবার ফের শঙ্করীকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে প্রথমে শঙ্করীকে ডেবরার লোয়াদায় ও সোমবার সকালে সবংয়ের তেমাথানির এক গুণিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে আগে থেকে কিছু জানতেন না বলে দাবি করছেন শঙ্করীর বাবা ঝড়ু সিংহ।

Advertisement

তিনি বলছেন, ‘‘হাওয়া লেগে কেউ অসুস্থ হয়ে এলে বাবার কথা শুনে আমি নিদান দিই। কিন্তু সাধারণ রোগে তো হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু মেয়েকে যে হাসপাতাল থেকে গুণিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে ওঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে কিছু জানাননি। পরে সব জেনেছি।”

যদিও শঙ্করীর সহকর্মীরা সব জানতেন। মকরামপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহায়িকা তথা আশা কর্মীদের ইন-চার্জ ইভা খাটুয়া বলেন, “আসলে মেদিনীপুর মেডিক্যালের চিকিৎসকরা শঙ্করীর পরিজনেদের ভয় দেখিয়েছিল বলে শুনেছি। সোমবার সকালে শঙ্করীর স্বামী আমাকে বলে, ওকে লোয়াদা থেকে তেমাথানির এক গুণিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সব জেনে আমি ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিককে বিষয়টি জানাই। তারপরেই জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে।”

শঙ্করীর ক্ষেত্রে জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা হস্তক্ষেপ করলেও কুসংস্কারের বেড়াজালটা এখনও ভাঙা যায়নি। মকরামপুরের বাসিন্দা পুষ্প বিশই বলছিলেন, “ডাইনের দৃষ্টি, হাওয়া লাগলে যে শরীর খারাপ হয় সেটা আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু শঙ্করী ও সবে বিশ্বাস করে না।’’ শঙ্করীর শাশুড়ি দুর্গা বেরাও বলেন, “হাওয়া না লাগলে এমন হয়! আমাদের ধারণা, ওঁর উপর কোনও ডাইনের দৃষ্টি পড়েছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘রবিবার মেডিক্যালের চিকিৎসকেরা তাঁদের শঙ্করীর বাঁচার আশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তাই তাঁরা শঙ্করীকে গুণিনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরে বৌমা কিছুটা সুস্থ হয়।” কিন্তু গুণিনে কেন এত বিশ্বাস? দুর্গাদেবী এ বার বলছেন, “আমি নিজে বিয়ের আগে অসুস্থ হয়েছিলাম। তখন ডেবরায় আমার বাপের বাড়ির এলাকার এক গুণিন আমাকে সুস্থ করেছিল। সেই থেকই আমার গুণিনে বিশ্বাস।”

এই এলাকারই কেউ কেউ আবার এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘একা লড়ে কিছু হবে না। এই কুসংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে সকলকে একসঙ্গে লড়তে হবে।’’ একই কথা বলছেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরাও। তিনি বলেন, “এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমরা শুধু নই, প্রশাসন, পঞ্চায়েত সকলকে লড়াই করতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন