চড়কের অগ্নিপথে যন্ত্রণার উদ্‌যাপন

মঙ্গলবার চৈত্র-অবসানের দুপুরে সুয্যি তখন মধ্য গগনে। মন্দির লাগোয়া উঠোনে গনগনে কয়লা মাড়িয়ে অবলীলায় এপার-ওপার হচ্ছেন ‘ভক্তা’ গ্রামবাসীরা। আর তাই দেখে তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছেন আবালবৃদ্ধবনিতা। আনুমানিক ষোড়শ শতকে নয়াগ্রামের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে রামেশ্বর শিব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। আগাগোড়া মাকড়া (ঝামা) পাথরের তৈরি এই মন্দিরকে ঘিরে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

রামেশ্বর (নয়াগ্রাম) শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫১
Share:

তপ্ত কয়লার উপর হাঁটছেন ‘ভক্তা’। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

মঙ্গলবার চৈত্র-অবসানের দুপুরে সুয্যি তখন মধ্য গগনে। মন্দির লাগোয়া উঠোনে গনগনে কয়লা মাড়িয়ে অবলীলায় এপার-ওপার হচ্ছেন ‘ভক্তা’ গ্রামবাসীরা। আর তাই দেখে তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছেন আবালবৃদ্ধবনিতা।

Advertisement

আনুমানিক ষোড়শ শতকে নয়াগ্রামের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে রামেশ্বর শিব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। আগাগোড়া মাকড়া (ঝামা) পাথরের তৈরি এই মন্দিরকে ঘিরে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে বারোটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। অরণ্যাঞ্চলের এই প্রাচীন মন্দিরের চড়ক উত্‌সবেও রয়েছে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের রামেশ্বর শিব মন্দিরের গাজন উত্‌সবটি কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। গাজন উত্‌সবের অনুসঙ্গ হিসেবে এখানে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার এই রীতির নাম ‘অগ্নি-পাট’। চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিতে ভক্তাদের কৃচ্ছ্রসাধনের অন্তিম পর্যায় দেখার জন্য ভিড় করেন মানুষজন। হবেই তো, এ যে সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার মহেন্দ্রক্ষণ।

যাঁদের দেখার জন্য এত উত্‌সাহ, তাঁরা কিন্তু গ্রামগঞ্জের সাধারণ চাষি। দৈনন্দিন জীবন-যন্ত্রণার বারোমাস্যার মধ্যেও তাঁরা বর্ষশেষে নিজেদের শরীরকে যন্ত্রণা দিয়ে যেন অলীক সুখের সন্ধান পান! স্থানীয় দেউলবাড় ও বিরিবেড়িয়া গ্রামের নীলকন্ঠ প্রধান, নিরঞ্জন প্রধান, শ্যামল প্রধান, বিশ্বম্ভর দেহুরি, নিতাই প্রধান, শম্ভুনাথ মাঝি, আকুল ভক্তা, খগেন প্রধান, বিদ্যাধর দাস, প্রবীর সিংহ ও কুশধ্বজ সিংহদের পরণে পীতবসন। তাঁদের গলায় অজস্র আকন্দ, ধুতরো ও কলকে ফুলের মালা। হাতে বেতের গাছি। নাগাড়ে বেজে চলা ঢোলের তালে ছন্দবদ্ধ ভাবে তেরো জন ভক্তা ক্রমাগত হাঁটলেন লালতপ্ত কয়লার উপর দিয়ে। হলুদ-জলে পা ধুয়ে ‘অগ্নি-পাট’ ক্রিয়া শেষ হতেই ভক্তাদের ধরা ছোঁয়ার জন্য জনতার সে কী আর্তি! শতাব্দী প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নাটমন্দিরের উপর থেকে ভক্তারা গলার আকন্দ ফুলের মালা ছুঁড়ে দেন হরির লুঠের মতো।

Advertisement

ভক্তাদের শিরোমণি ‘পাটভক্তা’ বৃদ্ধ নীলকন্ঠ প্রধান বলেন, “সেই যৌবনকাল থেকে প্রতি বছর গাজনের ভক্তা হচ্ছি। বছর শেষের সাতটা দিন আমরা মন্দিরেই থাকি। সারা দিন উপবাসের পর দিনান্তে সামান্য আহার। এ ভাবে দেবতার উদ্দেশ্যে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য শরীর ও মনটা তৈরি হয়ে যায়।” এ বছর প্রথমবার ভক্তা হয়েছেন নিতাই প্রধান। তিনি বলেন, “অগ্নিপাটের সময় মানুষের কোলাহলে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন কেউকেটা।”

রামেশ্বর মন্দির কমিটির সভাপতি সুধাংশু ঘোষের কথায়, “সাতটা দিন কঠোর সংযম পালনের ফলে হয়তো ভক্তাদের শরীরে কিছু প্রতিরোধ তৈরি হয়। যে কারণে আগুনে হাঁটলেও তাঁদের পায়ে ফোস্কা পড়ে না। এবার উত্‌সব দেখার জন্য পর্যটকও এসেছেন।”

রামেশ্বরের গাজন উত্‌সব যেন নীলকন্ঠবাবুদের জীবনযন্ত্রণার লড়াইয়ের প্রতীকী উদযাপন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন