তীব্র গরমে বিকেলেও সুনসান মেদিনীপুরের ব্যস্ত এলাকা কালেক্টরেট মোড় ।
চিড়িয়াখানায় এসেও মন খারাপ স্মিতার।
বেজার মুখে স্মিতা বাবাকে বলল, “ওরা তো খাঁচা থেকে বাইরে বেরোচ্ছেই না। কী দেখব! কিচ্ছু ভাল লাগছে না!” সত্যিই তো, পশু- পাখিদের নানা কাণ্ডকারখানা, লাফঝাঁপ দেখতেই তো চিড়িয়াখানায় আসা। কিন্তু তীব্র গরমে কাহিল পশুপাখিদের ফুরফুরে মেজাজটাই যেন উধাও।
চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিল বছর পাঁচেকের সঞ্চারি রায়। তার কথায়, “আগে খাঁচা থেকে পশু-পাখি হুটহাট করে বেরিয়ে যেত! এখন চিড়িয়াখানার পশু- পাখিরা তো খাঁচা থেকে বেরোতেই চাইছে না। মনে হয় ওরাও গরমে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। গরমটা কাটুক। পরে আবার চিড়িয়াখানায় আসব! তখন নিশ্চয়ই ওরা ভালই থাকবে!” বছর সাতেকের সপ্তর্ষি নাথ বলছে, “ওদের গুটিয়ে থাকতে দেখে খারাপই লাগছে। এই গরমটা যত তাড়াতাড়ি যায়, ততই ভাল!”
দুপুরে সুনসান মেদিনীপুরের চিড়িয়াখানায় বিকেল গড়াতে দর্শক আসছে বটে, তবে তাঁদের অধিকাংশই মন খারাপ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। চিড়িয়াখানায় পশু- পাখিদের দেখভাল করেন মন বাহাদুর সিংহ থাপা। মন বাহাদুর বলছেন, “যা গরম তাতে ওদের অতিষ্ঠ হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক। পশু- পাখিগুলো মাঝেমধ্যেই কাহিল হয়ে পড়ছে। রোদের তেজে প্রাণান্তকর অবস্থা। হোস পাইপ দিয়ে জল ছিটিয়ে ওদের মেজাজ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে!”
অবশ্য তাতে সুরাহা হচ্ছে নামমাত্রা। বাহাদুরের কথায়, “যতটা পারা যায় করছি। এখন দিনে একবার নয়, দু’-তিনবার স্নান করাতে হচ্ছে। খাঁচার দেওয়াল ও মেঝে জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হচ্ছে। ঘরের চালাতেও জল দিতে হচ্ছে।’’ সাদা ইঁদুর যেখানে রয়েছে, সেখানে ঘাসের স্তূপে জল দেওয়া হচ্ছে। গরম থেকে রেহাই পেতে ইঁদুরগুলো ঘাসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। মেদিনীপুরের এই চিড়িয়াখানার পরিদর্শক সুব্রত সরকার বলছেন, “এই গরমের তেজ সহ্য করাটা কঠিন। পশুদের অনেকেই জিভ বার করে হাঁপাতে থাকছে। গরমে কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়ছে। অসুস্থ হলে তখন ওষুধপত্র দিতে হচ্ছে।’’
মেদিনীপুর শহরে একটিই চিড়িয়াখানা রয়েছে। জেলা পরিষদ রোডের অদূরে অরবিন্দ শিশুউদ্যান ও চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় কী কী রয়েছে এখানে? রয়েছে খরগোশ, সাদা পায়রা, গিনিপিগ, শেয়াল, রাজহাঁস, বদ্রী পাখি, ককটেল পাখি, সাদা ইঁদুর, ময়ূর, এমু পাখি প্রভৃতি।
ছায়ায় ঠাঁই মেদিনীপুর চিড়িয়াখানায়। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
শুধু চিড়িয়াখানা নয়, শহর মেদিনীপুরেও এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। অস্বস্তিকর গরমে যেন ঘর থেকে বেরোনোই দায়! বেলা গড়াতেই শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোও সুনসান হয়ে যাচ্ছে। পথেঘাটে সেই ভিড় উধাও। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। বেরোলে টুপি- রোদ চশমা নিচ্ছেন। কেউ কেউ সময় বের করে রাস্তার পাশে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। পকেট সায় দিলে ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিচ্ছেন। মেদিনীপুরের বাসিন্দা অলোক পাল বলছেন, “এই গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না। দুপুরের পর বাড়ি থেকে বেরোতেই ইচ্ছে করছে না। কবে যে একটু বৃষ্টি হবে!’’
চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদেরও একই হাল! দিনের বেশিরভাগ সময়ই খাঁচার মধ্যেই বন্ধ হয়ে রয়েছে পশু-পাখিরা। বিকেলের দিকে অবশ্য মুখ দেখাচ্ছে তারা। সুব্রতবাবু বলছিলেন, ‘‘খাঁচার আশপাশে পরিকল্পনা করে কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। ফলে, গরমটা একটু কম লাগছে। তবে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি হলে গাছ লাগিয়ে কতটাই বা গরম এড়ানো যায়! টানা গরমে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো সত্যিই খুব কাহিল হয়ে পড়ছে।”
সুব্রতবাবু জানাচ্ছেন, এরমধ্যেও পশু-পাখিদের শরীর ঠিক রাখতে নজর রাখা হচ্ছে। যখনই তারা গরমে হাঁসফাঁস করছে, তখনই কর্মীরা হোস-পাইপ দিয়ে জল ছেটাচ্ছেন। পশু চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। বছরের অন্য সময় অবশ্য এই পশু-পাখিদের আচরণ থাকে একেবারে অন্য রকম। আর ক’দিন পরেই যে তাপমাত্রা দ্রুত নামবে, এমন পূর্বাভাসও নেই। বাহাদুর বলছিলেন, ‘‘আর পারা যাচ্ছে না। এ বার বৃষ্টিটা খুব দরকার!”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা জানাচ্ছেন, “গরমে অসুস্থ হয়ে যাঁরা আসবেন, তাঁদের দিকে বাড়তি নজর রাখার কথা প্রতিটি হাসপাতালকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত ওআরএস পাঠানো হয়েছে।’’ জেলার এক স্বাস্থ্য-কর্তার বক্তব্য, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশেষত, যারা মাঠে ময়দানে অনেকক্ষণ পরিশ্রম করেন। তাঁদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওই স্বাস্থ্য-কর্তার পরামর্শ, সরাসরি তাপপ্রবাহ এড়ানোর জন্য ছাতা ব্যবহার করা উচিত। মাথা ও কাঁধে ভিজে গামছা তোয়ালে বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত। সময় সময় শরীরের ঘাম মুছে ফেলা উচিত। গরমের সময় ঢিলে এবং হালকা রঙের সুতির তৈরি জামাকাপড় পরা জরুরি।
এখন শুধু বৃষ্টির প্রত্যাশা চাতক শহরের।