অভিযুক্ত হাফিজুল লস্কর। —দেবরাজ ঘোষ
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসনেই থাকেন চিকিৎসক। অথচ মুমূর্ষু এক রোগীকে দেখলেন না তিনি। পরে মৃত্যু হয় বছর পঁচাশির ওই বৃদ্ধের। তারপরেই মৃতের পরিবারের লোকজনেরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চড়াও হয়ে মারধর করেন ওই চিকিৎসককে। বৃহস্পতিবার সাঁকরাইল ব্লকের কুলটিকরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘটনা।
জানা গিয়েছে, এ দিন সকালেই কুলটিকরি শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় গোবর্ধন পড়্যা নামে ওই বৃদ্ধকে। পরিবারের অভিযোগ, কর্তব্যরত নার্স ভর্তি নিতে অস্বীকার করেন। এমনকী সামান্য অক্সিজেন দিতেও অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, চিকিৎসক অসুস্থ, তাই কাউকে ভর্তি নেওয়া যাবে না।
বাধ্য হয়েই আবার পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভাঙাগড় গ্রামীণ হাসপাতালে নিযে যাওয়া হয় বৃদ্ধকে। কিন্তু সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরে সকাল সাড়ে ৯ টা নাগাদ উত্তেজিত মৃতের পরিজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা কুলটিকরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার হাফিজুল লস্করের কোয়ার্টারে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। চিকিৎসককে নিজের কোয়ার্টারে তালাবন্ধ করে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে সাঁকরাইল থানার পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে। ঘটনার পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং লাগোয়া কোয়ার্টারে পুলিশ প্রহরা বসানো হয়। তদন্তে আসেন ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ডিএসপি (সদর) কল্যাণ সরকার এবং সাঁকরাইলের বিএমওএইচ বাসববিজয় শীট।
অভিযুক্ত চিকিৎসক অবশ্য দাবি করেছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্বিতীয় কোনও চিকিৎসক নেই। গত দু’মাস তিনি একা কাজ করছেন। বিষয়টি উপর মহলে জানানো হলেও কোনও চিকিৎসক দেওয়া হয়নি। হাফিজুল বলেন, “আমার শরীর খারাপ। তাই মঙ্গলবার অন্তর্বিভাগে সব রোগীকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কোনও চিকিৎসক নেই, তাই অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি নিতে নিষেধ করেছিলাম।”
যদিও জানা গিয়েছে, কয়েক মাস আগে জামবনি ব্লকের চিচিড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এক চিকিৎসককে কুলটিকরিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, কুলটিকরিতে কাজের পরিবেশ নেই, তিনি সেখানে কাজ করতে পারবেন না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিন জন নার্স। অথচ ডিউটি করেন মাত্র দু’জন। মাত্র একজন জিডিএ (জেনারেল ডিউটি অ্যাটেনডেন্ট)। বেশির ভাগ দিনই বহির্বিভাগে চিকিৎসক বসেন না, রোগী দেখেন ফার্মাসিস্ট জসিমউদ্দিন ভাঙ্গি। হাফিজুল লস্কর বেশির ভাগ সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন না। সেই কারণে ফার্মাসিস্ট আউটডোরে রোগী দেখেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দশটি শয্যা থাকলেও রোগীদের ভর্তি নেওয়া হয় না। রোগীদের ৫ কিমি দূরের গ্রামীণ হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। অথচ কুলটিকরি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার দশেক বাসিন্দা এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল।
অভিযুক্ত ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর সহকর্মীরাও। কয়েক মাস আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন নার্সকে হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠে হাপিজুল লস্করের নামে। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অভিযোগও করেন। কিন্তু ওই নার্সকেই অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। অভিযোগের কোনও তদন্ত হয়নি।
এ দিনও কর্তব্যরত নার্স শুভ্রা দাস অভিযোগ করেন, ‘‘সঙ্কটজনক অবস্থা দেখে ওই বৃদ্ধকে অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়ে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি নিষেধ করেন।”
দুপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, বাইরে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অর্ন্তবিভাগের দশটি শয্যাই খালি। বর্হিবিভাগের রোগীরা আর আসেননি। গোবর্ধনবাবুর ছেলে স্থানীয় ব্যবসায়ী সনাতন পড়্যা বলেন, “চিকিৎসক নিজের কোয়ার্টারের চেম্বারে ছিলেন। পায়ে ধরে অনেক অনুনয় করলাম। কিন্তু কিছুতেই বাবাকে দেখতে এলেন না। অক্সিজেনও দিতে দিলেন না।”
ঝাড়গ্রামের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অশ্বিনীকুমার মাঝি বলেন, “চিকিৎসককে মারধর করার ঘটনাটি অন্যায়। তবে ওখানে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ পাশাপাশি তিনি জানান, কেন দ্বিতীয় চিকিৎসক কাজে যোগ দিচ্ছেন না, তা বিএমওইচকে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে বলেছেন তিনি।