ছবি এএফপি।
ভৌগোলিক সীমারেখা দিক থেকে দু’টি বিধানসভায় পূর্ব মেদিনীপুরের অন্তর্গত। কিন্তু ‘রাজনৈতিক সীমারেখা’র দিক থেকে এলাকা দু’টি পশ্চিম মেদিনীপুরের লোকসভা কেন্দ্রের আওতাধীন। বৃহস্পতিবার লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে পূর্ব মেদিনীপুরে উড়েছে শাসকদল তৃণমূলের পতাকা। কিন্তু জেলার অংশ হলেও ব্যতিক্রমী ওই দু’টি লোকসভা— পাঁশকুড়া পশ্চিম এবং এগরা। প্রথমটির ক্ষেত্রে তৃণমূলের প্রার্থী লোকসভায় কেন্দ্রে জয়ী হলেও ‘হেরেছেন’ সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রে। অন্য কেন্দ্রটিতে এবার ফুটেছে পদ্মফুল।
স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মধ্যে ওই ফলাফল নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি ‘অধিকারী গড়’ পুরোপুরি রক্ষা করতে পারলেন না শাসকেরা!
পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভা ঘাটাল লোকসভার অন্তর্গত। ২০১৪ সালে ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব) জিতেছিলেন ২ লক্ষ ৬০ হাজারেরও বেশি ভোটে। এবারে তাঁর ‘প্রধান’ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একদা তৃণমূল সরকারের দাপুটে পুলিশ অফিসার ভারতী ঘোষ। তাঁকে ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটে হারিয়েছেন দেব। কিন্তু পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভায় ভারতী পেয়েছেন ৯৭৫২৮টি ভোট। তুলনায় দেব পেয়েছেন ৯৪৬৮৩টি ভোট।
এর কারণ হিসাবে রাজনৈতিক মহলের তরফে উঠে এসেছে তিনটি তত্ত্ব। প্রথমত, বামেদের ভোট বিজেপি’র দিকে যাওয়া, দ্বিতীয়ত তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং তৃতীয়ত, ধর্মীয় মেরুকরণ। এলাকার প্রাক্তন বাম বিধায়ক চিত্তরঞ্জন দাশঠাকুরের কথায়, ‘‘এলাকার বাম কর্মী-সমর্থকেরা আমাদের মিছিলে হাঁটলেও বেশিরভাগই ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে। ফলে পাঁশকুড়ায় বামফ্রন্ট দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্থানে এসে পৌঁছেছে। মানুষকে তো আর ধরে রাখা যায় না। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ রয়েছে।’’
অন্যদিকে, স্থানীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের আদি এবং নব্য সদস্যের মধ্যে ‘মনোমালিন্য’ আদি সদস্যদের বিজেপিমুখো করেছে। যদিও এ ব্যাপারে স্থানীয় কোনও নেতাই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। এছাড়া রয়েছে এক সময়ের জনপ্রিয় তৃণমূল নেতা আনিসুর রহমানের সাথে ব্লক কার্যকরী সভাপতি কুরবান শা'র কোন্দল। আনিসুর পরে বিজেপি’তে যোগ দেন।
২০১১ সালে পরিবর্তনের পর থেকে পাঁশকুড়ায় শাসক দলের রাশ সামলে আসছেন সংখ্যালঘু নেতা। এতে মেরুকরণের রসায়ন কিছুটা হলেও উস্কে দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন তৃণমূলের পাঁশকুড়া ব্লক সভাপতি দীপ্তি জানা। তিনি বলেন, ‘‘পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভা এলাকার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ভোট আমাদের পক্ষে গেলেও বাকি অংশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।’’ তবে স্থানীয় বিজেপি নেতা সিন্টু সেনাপতি’র যুক্তি, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন।’’
আবার এগরা রয়েছে মেদিনীপুর লোকসভায়। গত বিধানসভায় তৃণমূল ওই কেন্দ্রে এক লক্ষ ১৩ হাজার ৩৩৪টি ভোট পেয়ে জোট প্রার্থীকে ২৫,৯৫৬ ভোটে হারিয়ে বিধানসভা দখল করে। এবার সেখানে বিজেপি পেয়েছে এক লক্ষ ন’হাজার ৫০৯টি ভোট আর তৃণমূল প্রার্থী মানস ভুইঁয়্যা পয়েছেন এক লক্ষ ৮১৫টি ভোট। এর কারণ হিসাবেও উঠে এসেছে শাসকের পুরসভা এবং ব্লক স্তরের গোষ্ঠী কোন্দলের তত্ত্ব। আবার স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, শাসকদলের নেতার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগও মানুষকে বিজেপি’র দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এগরা শহর তৃণমূলের সভাপতি স্বপন নায়ক বলেন, ‘‘ব্লকে এবং শহরে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল এবং দুর্নীতি মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। শহরের ভোট কমা নিয়ে আশঙ্কা ছিল। তবে ব্লকের মধ্যে ভোটের লিড কমায় গোষ্ঠী কোন্দলই মূলত দায়ী। নির্দল হয়ে যারা পঞ্চায়েতে লিড করেছিলেন, তাঁরাই বিজেপিকে সাহায্য করেছেন। কেন এই ভরাডুবি, তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হবে।’’ এগরা বিধানসভার বিজেপির আহ্বায়ক অরূপ দাসের বক্তব্য, ‘‘গত পঞ্চায়েতে মানুষের ভোটাধিকার যেভাবে তৃণমূল কেড়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মানুষ এবারে ভোট দিয়েছেন।’’