পথে নেমে নিত্য হোঁচট, ক্ষুব্ধ পুরবাসী

জেলা শহরের তকমা জুটেছে সে প্রায় এক যুগ হল। অবিভক্ত মেদিনীপুর ভাগ করে প্রশাসনিকভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সদর হিসেবে ঘোষণার সময় আশায় বুক বেঁধেছিলেন রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু রাজ্যের অন্য জেলা সদরগুলির সঙ্গে তুলনা টানতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খাচ্ছেন জেলা সদর তমলুক শহরের বাসিন্দারা।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

তমলুক শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০০:৫১
Share:

রাস্তার দু’পাশে ভিড় বেআইনি দোকানদারদের। হলদিয়া- মেচেদা রাজ্য সড়কে পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।

জেলা শহরের তকমা জুটেছে সে প্রায় এক যুগ হল। অবিভক্ত মেদিনীপুর ভাগ করে প্রশাসনিকভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সদর হিসেবে ঘোষণার সময় আশায় বুক বেঁধেছিলেন রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু রাজ্যের অন্য জেলা সদরগুলির সঙ্গে তুলনা টানতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খাচ্ছেন জেলা সদর তমলুক শহরের বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরের রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি।

Advertisement

একসময়ের প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্ত থেকে কালক্রমে তমলুক নামে পরিচিত হয়েছে এই শহর। পুরসভা হিসেবে গুনতে গুনতে পার হয়ে গিয়েছে দেড়শো বছর। আর সার্ধশতবর্ষ পালনের মুখে শহরের পুরসভার নাম বদলে ফের তাম্রলিপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু শহরের নাম পরিবর্তন করা হলেও শহরের রাস্তা সারানো বা সাজানো-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরসভা নজর দেয়নি বলে অভিযোগ শহরবাসীর। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০২ সালের পয়লা জানুয়ারি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নবগঠিত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সঙ্গে জেলা প্রশাসনিক সদর হিসেবে তমলুক শহরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার কয়েক মাস পরই শহরের মাঝ দিয়ে যাওয়া হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়ক সম্প্রসারণ করার জন্য সড়কের দু’ধারে পূর্ত দফতরের জায়গা বেদখল করে গড়ে ওঠা দোকানঘর-সহ বিভিন্ন অবৈধ নির্মাণ অপসারণের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সেই সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায়।

শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের মানিকতলা থেকে, রাজ ময়দান, জেলখানা মোড়, পুরসভা অফিস, স্টিমারঘাট, বর্গভীমা মন্দির, বড়বাজার হয়ে হাসপাতাল মোড় ও নিমতলা পর্যন্ত পাকা রাস্তা পূর্ত দফতরের অধীনে থাকলেও ওই রাস্তার দু’ধারের এলাকায় ফুটপাথ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বাসিন্দাদের সুবিধার্থে পায়রাটুঙি থেকে রূপনারায়ণ নদীর বাঁধ বরাবর চককামিনা পর্যন্ত পাকা বাইপাস রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হলেও স্থানীয় সমস্যায় আটকে গিয়েছে। তমলুক থানার অফিসের কাছে রাজাবাজার কাছ থেকে টাউন স্কুল, ধর্মশালা হয়ে বড়বাজার পর্যন্ত রাস্তা, শঙ্করআড়া বাসপুল থেকে শ্মশানঘাট, বর্গভীমা মন্দির থেকে চলন্তিকা মোড়, জেলখানা মোড় থেকে পায়রাটুঙ্গি খাল পর্যন্ত রাস্তাগুলি অনেক দিন আগেই পিচের হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এইসব পাকা রাস্তাগুলির কোন উন্নয়ন হয়নি বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ ।

Advertisement

শহরের রাস্তার ছবিটা আগে কিন্তু ছিল অনেকটাই আলাদা। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা ৯০ বছরের চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু শোনালেন অন্য গল্প। তিনি জানান, পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে তমলুক শহর হয়ে হলদিয়াগামী রাস্তাটি ছিল শহরের প্রধান রাস্তা। তমলুক শহরের কাছে এই রাস্তাটি আদতে ছিল রূপনারায়ণ নদীর বাঁধ। তখন এই রাস্তার পশ্চিম দিকে লোকজনের বসবাসের বাড়ি থাকলেও পূর্ব দিকে তেমন বাড়িঘর ছিল না। ১৯৩০ সাল মাটির রাস্তা থেকে পাথর ফেলে পাকা হয়। ১৯৪০ সাল নাগাদ রাস্তাটি পিচের হয়। তখন তমলুক থেকে পাঁশকুড়া হয়ে মেদিনীপুর পর্যন্ত বাস চলাচল করত। শহরের মধ্যে এই রাস্তা দিয়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাস চলাচল করেছে। পরবর্তী সময়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে মেচেদা থেকে তমলুক শহরের মানিকতলা, শঙ্করআড়া, হাসপাতাল মোড় হয়ে নিমতলা পর্যন্ত বাইপাশ সড়ক তৈরি হয়। যেটি আজকে হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কের অংশ। তাঁর কথায়, “জেলা সদর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাস্তাঘাট ভাল করা, নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়ন, শহরের আরও বাজার গড়া দরকার।” শহরের প্রবীণ বাসিন্দা তথা তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রণব বাহুবলীন্দ্রের অভিযোগ, “শহরের প্রধান রাস্তাঘাটগুলি চওড়া করে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা দূরের কথা, ধীরে ধীরে রাস্তা সরু হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ রাস্তার দু’ধারের ফুটপাথ হয় ভাঙাচোরা অথবা নেই বললেই চলে। শহরের সৌন্দর্যায়ন নিয়ে পুরসভার তো কোনও হেলদোলই নেই।”

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে ২০টি ওয়ার্ড বিশিষ্ট তমলুক পুরসভার অধীনে ১৪২.৩০ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা পাকা পিচের। বাকি রাস্তা পাকা কংক্রিটের। শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হচ্ছে না। শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিক্ষিপ্তভাবে দায়সারাভাবে কিছু রুটিন মাফিক কাজ করা ছাড়া সামগ্রিকভাবে শহরের উন্নয়নের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। সামনেই পুর ভোট। এই পরিস্থিতিতে বেহাল রাস্তা বিরোধীদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কশহরের মাঝ বরাবর হরির বাজার মোড়ের কাছ থেকে মালিজঙ্গল পল্লি হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন পর্যন্ত রাস্তার একসময় নাম ছিল ‘বিউটি রোড’। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী রামকৃষ্ণ দে-র অভিযোগ, “রাস্তাটি বেশ কয়েক দিন ধরেই বেহাল পড়ে রয়েছে। রাস্তা মেরামতির জন্য পুরসভার কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।” বেহাল এই রাস্তা নিয়ে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী তথা পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সির সুব্রত রায়ের বক্তব্য, “ওই রাস্তার মেরামতির জন্য ইতিমধ্যে পুরসভায় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।”

সমস্যার কথা স্বীকার করে বিদায়ী পুরপ্রধান দেবিকা মাইতি জানান, শহরের প্রধান রাস্তাগুলির অধিকাংশই পূর্ত দফতরের হাতে রয়েছে। ওই সব রাস্তার দু’ধারে কয়েকটি ফুটপাথ তৈরির জন্য পুরসভার তরফে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা হয়েছে। পুরপ্রধানের কথায়, “শহরের প্রধান রাস্তাগুলির দু’ধারে ফুটপাথ তৈরির জন্য সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী উদ্যোগী হয়েছেন। এ জন্য হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ থেকে অর্থ বরাদ্দ করে শহরে রাস্তায় ফুটপাথ তৈরির কাজ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন