মেছো দহের বুকেই আজ আধুনিকতার ছোঁয়া

সে প্রায় একশো বছর আগের কথা। হাওড়া স্টেশন থেকে খড়গপুর হয়ে নাগপুর পর্যন্ত রেললাইন তৈরি হচ্ছিল গ্রামের উপর দিয়ে। ব্রিটিশ আমলে এই এলাকার গোমস্তার সঙ্গে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি গোবিন্দ সামন্তের খুব সখ্য ছিল। সেই সুবাদে গ্রামের অদূরের স্টেশনের নামকরণ গোবিন্দবাবুর সুপারিশ অনুযায়ী হয় মেছেদা। আজকের ঝাঁ চকচকে মেচেদা স্টেশনের সেই শুরু।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

মেচেদা  শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৫ ০০:১৭
Share:

পুরনো গ্রাম মেছেদার বুড়ো শিব মন্দির আর উল্টোদিকের আটচালা।

সে প্রায় একশো বছর আগের কথা। হাওড়া স্টেশন থেকে খড়গপুর হয়ে নাগপুর পর্যন্ত রেললাইন তৈরি হচ্ছিল গ্রামের উপর দিয়ে। ব্রিটিশ আমলে এই এলাকার গোমস্তার সঙ্গে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি গোবিন্দ সামন্তের খুব সখ্য ছিল। সেই সুবাদে গ্রামের অদূরের স্টেশনের নামকরণ গোবিন্দবাবুর সুপারিশ অনুযায়ী হয় মেছেদা। আজকের ঝাঁ চকচকে মেচেদা স্টেশনের সেই শুরু।

Advertisement

এর মধ্যে রূপনারায়ণ দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। মেচেদা স্টেশন, কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড ও রাজ্যের বৃহত্তম কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে ক্রমে বড় হয়েছে এই এলাকা। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষদের বসবাসের অন্যতম এক জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছে মেচেদা। স্টেশনের পাশে কাকডিহি, শান্তিপুর, গুলুড়িয়া, আন্দুলিয়া, বড়গাছিয়া, বাড় বহলা, হাকোলা, শ্রীকৃষ্ণপুর, খাঞ্জাদাপুর, রামচন্দ্রপুর প্রভৃতি গ্রাম এখন মেচেদা শহর এলাকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যে এলাকা মেচেদা নামে পরিচিত তা কিন্তু মেচেদা গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে। মেচেদা স্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পূর্বে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উত্তর পাশে রয়েছে মেছেদা গ্রাম। কোলাঘাট ব্লকের আমলহান্ডা পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা সেই মেছেদা গ্রাম যেন প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মত। মেচেদা বাজারের সঙ্গে মেছেদা গ্রামের ভৌগোলিক দুরত্ব এক কিলোমিটার হলেও বেহাল রাস্তাঘাটের নিরিখে তা অনেক দূরের। অনেকটা অভিমানে নিজেদের মেছেদা শহর থেকে আলাদা পরিচয় বোঝাতে এলাকার বাসিন্দারা পরিচয় দেন ‘গ্রাম মেছেদার’ বাসিন্দা হিসেবে। কয়েক বছর আগেও গ্রামের বেশ কিছু অংশে হোগলা বন ছিল। এলাকার বাসিন্দা তথা সাহিত্যিক স্বপন বাগের কথায়, ‘‘অনেকেই আমাদের এলাকাকে গ্রাম মেচেদা বলেন। মেছেদা নামে আমাদের যে আলাদা একটি গ্রাম আছে তা অনেকেই বুঝতে চান না। ডাকযোগে চিঠিপত্র আদানপ্রদানে অসুবিধা হয়ে থাকে।’’

আজকের আধুনিক মেচেদা শহর গড়ে ওঠার আগে কেমন ছিল সেই প্রাচীন মেছেদা? মেচেদার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সুকুমার মাইতির কথায়, ‘‘অনেক আগে রূপনারায়ণ নদীতীরবর্তী এই এলাকার অধিকাংশ নিচু জলাভুমি বা দহ ছিল। বনজঙ্গল ভরা সেই নিচু জলাভুমিতে প্রচুর মাছ হত। আর এই মাছের দহ থেকে মেছো দহ, আর মেছোদা থেকে আজকের মেছেদা বা মেচেদা নামের উৎপত্তি বলে অনুমান।’’ একসময় বর্ধমান রাজার অধীনে থাকা মণ্ডলঘাট পরগনার অন্তর্গত ছিল মেছেদা গ্রাম। কিসমত মেছেদা ও মেছেদা নামে গ্রামের দুটি অংশ ছিল দুই জমিদারের অধীনে। পরবর্তী সময়ে মেছেদা মৌজা নামে পরিচিত হয় সরকারিভাবে। মেছেদা গ্রামের অধিকাংশ পরিবার ছিল কৃষিজীবী। পরবর্তী সময়ে রেললাইন তৈরির সুবাদে ১৯৩০-৪০ সাল নাগাদ গ্রামের অনেকেই রেলে চাকরি পান। ১৯৭৩ সাল নাগাদ কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য মেছেদা গ্রামের সমস্ত কৃষিজমি ও কিছু বসতি এলাকা সহ অধিকাংশ এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়। ফলে এখন মেছেদা গ্রামের আয়তন অনেকটাই কমে গিয়েছে।

Advertisement


ক্রমশ বহুতলে মুখ ঢাকছে শহর।

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মদন দোলইয়ের কথায়, ‘‘একসময় মেছেদা গ্রামের লাগোয়া কাকডিহি গ্রামের বটতলায় বসত হাট। এলাকার মানুষের কাছে ‘হরির হাট ’ বা ‘ বটতলার বাজার ’ নামে পরিচিত সেই হাট এলাকা আজকে মেছেদা পুরাতন বাজার নামে পরিচিত।’’ ব্রিট্রিশ আমলে তৈরি বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানি ১৮৯৭ সাল নাগাদ হাওড়া থেকে খড়গপুর পর্যন্ত নতুন রেললাইন তৈরির সময় হাওড়া থেকে কোলাঘাট হয়ে মেছেদা গ্রামের উপর দিয়ে খড়্গপুরগামী রেললাইন তৈরির ফলে মেছেদা গ্রামের উপর দিয়ে যায়। ফলে মেছেদা গ্রাম দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। গ্রামের মাঝদিয়ে যাওয়া রেলপথের একটি স্থানে গ্রামের দুই অংশের জলনিকাশির জন্য একটি পাকা নালা তৈরি করা হয়। যা এলাকায় ‘ঘুঘুপোল’ নামে পরিচিত। আর মেছেদা গ্রাম থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে ১৯০১ সালে গুড়ুলিয়া ও বাড়বহলা গ্রামের মাঝে একটি স্টেশন তৈরি করা হয়। নতুন ওই স্টেশনের নামকরণ হয় মেছেদা।

তৎকালীন তমলুকের মহকুমা শাসক রিচারডসন সাহেবের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ‘রিচারডসন রোড’। ওই মাটির রাস্তাটি তমলুক শহরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৬০ সালে মেছেদা স্টেশন থেকে তমলুক পর্যন্ত পাকারাস্তায় বাস চলাচল শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে চালু হয় মেছেদা-তেরপেখিয়া, মেছেদা-নরঘাট, শ্রীরামপুর, মেছেদা–হলদিয়া বাস চলাচল। মেছেদা স্টেশনের কাছ দিয়ে হলদিয়া-মেছেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক তৈরির শুরুর পরে ১৯৮৩ সাল নাগাদ ওই জাতীয় সড়ক চালুর পরে নতুন হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যপক উন্নতি ঘটে । ইতিমধ্যে ১৯৭৩ সাল নাগাদ মেছেদা রেলস্টেশনের কাছেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এশিয়ার বৃহত্তম কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সময় থেকেই কাজের সূত্রে এখানে আসা ইঞ্জিনিয়ার, কর্মী, শ্রমিক মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে মেছেদা বাজার এলাকা। আশির দশক থেকেই মেছেদা এলাকায় শুরু হয় নগরায়ণের সুত্রপাত। একদিকে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উত্তরে দিকে কয়েক কিলোমিটার দুরেই তাপবিদ্যুৎ আধিকারিক-কর্মীদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় পরিকল্পিত দুটি উপনগরী। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম শিল্পকেন্দ্র ও আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকা মেছেদা ও কোলাঘাট এলাকাকে পুরসভা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজ্য সরকার। তাই গ্রাম থেকে শহরবাসী হিসেবে স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছেন মেচেদার বাসিন্দারা।

ছবি:পার্থপ্রতিম দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন