জাতীয় সড়কে বাড়ছে বিপদ

রাস্তা আটকে গাড়ি, দেখেও দেখে না পুলিশ

দৃশ্য এক: বেলা তখন বারোটা। খড়্গপুর-ভুবনেশ্বর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে রূপনারায়ণপুরে একটি ধাবার পাশে দু’টি লেন দখল করে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রাক।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল ও দেবমাল্য বাগচী

তমলুক ও খড়্গপুর শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০১:০৪
Share:

৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে এ ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে লরি। বড়দাবাড়ের কাছে পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।

দৃশ্য এক: বেলা তখন বারোটা। খড়্গপুর-ভুবনেশ্বর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে রূপনারায়ণপুরে একটি ধাবার পাশে দু’টি লেন দখল করে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রাক। দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সেই সব ট্রাকের একটি তো একেবারে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। ভেতরে গান চালিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন চালক। আর খালাসি তাল ঠুকছেন। এ ভাবে রাস্তা আটকে ট্রাক রেখেছেন কেন? কাঁচুমাঁচু করে খালাসি পালানি স্বামী বললেন, “বেঙ্গালুরু থেকে টম্যাটো নিয়ে কলকাতা যাচ্ছি। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়েছি। একটু পরেই চলে যাব।”

Advertisement

দৃশ্য দুই: কলকাতা-মুম্বই ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে খড়্গপুর থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে চৌরঙ্গীর কাছেও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাক। সেগুলো অবশ্য পুলিশই দাঁড় করাচ্ছে। এক কনস্টেবল গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা হচ্ছে।’’ একটি ট্রাকের খালাসি শেখ আলঙ্গির জানালেন, প্রায়ই খড়্গপুর থেকে হলদিয়া বন্দরে যান এই পথে। পুলিশ ‘ওভারলোড’ রয়েছে বলে আটকায়। তারপর বৈধ কাগজ দেখালেও এক থেকে দু’হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়াতে হয়।

দৃশ্য তিন: কোলাঘাটের বরদাবাড়ের কাছে জাতীয় সড়কের ধারে রয়েছে একাধিক খাবার হোটেল, ধাবা। তার সামনেই সড়কের একাংশ দখল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে লরি, ট্যাক্সি। দেউলিয়া বাজারে জাতীয় সড়কের খড়্গপুরগামী লেনের প্রায় অর্ধেক অংশ দখল করে চলছে জমজমাট সব্জি বাজার। কোলাঘাটের দিগলাবাড় ও পাঁশকুড়ার জানাবাড় গ্রামের কাছে জাতীয় সড়কের একাংশের ধান শুকনো করতে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

জাতীয় সড়ক দেশের জীবনরেখা। অথচ এই রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলি মরণফাঁদ হয়ে উঠছে। হামেশাই ছোট-বড় দুর্ঘটনা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার বিকেলে সিঙ্গুরের কাছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা দুধের গাড়িতে ধাক্কা মেরেছিল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গা়ড়ির কনভয়। দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে কলকাতার একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন অভিষেক। এর আগে ২০১০ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে কোলাঘাটের কাছে তাঁর কনভয়ের মধ্যে আচমকা একটি লরি ঢুকে পড়েছিল। সেই ঘটনায় লরির চালককে গ্রেফতার গ্রেফতার হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা রুজু হয়েছিল। তবে লরির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছিল বলে চালক দাবি করেছিলেন।

৬ নম্বর এবং ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের সংযোগস্থল খড়্গপুরের রূপনারায়ণপুরে এই প্রবণতা সব থেকে বেশি। শিল্পতালুক হওয়ায় এখানে ট্রাকের আনাগোনাও বেশি। ফলে, দু’টি সড়কের ধারেই প্রতিদিন দীর্ঘক্ষণ ট্রাক-লরি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। শুধু রূপনারায়ণপুর নয়, ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের খড়্গপুরের নিমপুরা, সাহাচক, বুড়ামালা, ডেবরা এবং ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের জকপুর, মকরামপুর, বেলদা, দাঁতন সোনাকানিয়ায় ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শুধু দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে নয়, রাজ্যের অন্যান্য জাতীয় সড়কগুলিতে পথ নিরাপত্তার হাল খতিয়ে দেখার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।

ট্রাক চালকদের একাংশের দাবি, বিশ্রামের প্রয়োজনেই তাঁদের রাস্তার ধারে দাঁড়াতে হয়। সর্বত্র ট্রাক টার্মিনাস না থাকায় রাস্তার ধারেই গাড়ি রাখতে হয়। আবার অনেক ট্রাক চালকের দাবি, পুলিশ অন্যায় ভাবে টাকা আদায়ের জন্য রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে। মহারাষ্ট্রের পুণে থেকে ধুলাগড় যাওয়ার পথে ট্রাক চালক কৈলাস যাদবও বললেন, “অধিকাংশ রাস্তাতেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। এটা ঠিক এ ভাবে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদের আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু আমরাও অসহায়।’’ এলাকার পানের দোকানদার শেখ তৈবুল বলেন, ‘‘ডিভাইডারের উপর রেলিং না থাকায় অনেকে বেআইনিভাবে লেন পারাপার করে। ফলে দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।’’

এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, জাতীয় সড়কের ধারে সরকারি জায়গা দখল করে ধাবা, হোটেল হলেও প্রশাসন ও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে ব্যস্ত জাতীয় সড়কের ধার দখলের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। যা সড়কে গাড়ি চলাচলের পক্ষে ক্রমশ সঙ্কট তৈরি করছে। তবে সমস্যার কথা স্বীকার করে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘জাতীয় সড়কের ধারে যাতে গাড়ি ঠিকভাবে রাখা হয়, সেজন্য কয়েকদিনের মধ্যে হাইওয়ে পেট্রলিং শুরু হবে। যাতে গাড়িগুলো বেআইনি পার্কিং না করে, তার জন্য কড়া পদক্ষেপও করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন