রাত তখন দেড়টা। ঘুম ভেঙে কাঁদছিল আড়াই বছরের অ্যাঞ্জেল দে। বাবা-মা দেখলেন মুখ ফুলে ঢোল, ব্যথায় ছটফট করছে মেয়ে। এক চিকিৎসককে ফোন করে সমস্যা জানাতেই তিনি ওষুধের নাম বলে দিলেন। অ্যাঞ্জেলের বাবা দেবাশিস দে ওষুধ কিনতে সেই রাতে হন্যে হয়ে ঘুরলেন। কিন্তু তখন শহরের সব ওষুধের দোকান বন্ধ। এমনকী হাসপাতাল সংলগ্ন ওষুধের দোকানগুলিও খোলা নেই। অবশেষে হাসপাতালের ভিতরে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলা দেখে স্বস্তি পেয়েছিলেন দেবাশিসবাবু। কিন্তু সেখানে তো ওষুধটাই নেই!
দেবলপুরের বাসিন্দা দেবাশিসবাবুর মতো দশা হচ্ছে খড়্গপুর শহরের বহু বাসিন্দারই। শহরের বুকে রাতে ওষুধের দোকান খোলা না থাকায় বাড়ছে ভোগান্তি। একমাত্র সহায় নায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। কিন্তু সেখানে মিলছে না বেশিরভাগ ওষুধই। এমনকী হাসপাতালের চিকিৎসকদের লিখে দেওয়া ওষুধও সেই দোকানে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ। খড়্গপুর আইআইটি-র বিসি রায় হাসপাতাল চত্বরের একটি ওষুধের দোকান অবশ্য রাতে খোলা থাকে। তবে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে সেখানে সবাই ঢুকতে পারেন না। সেই রাতে অবশ্য ওই ওষুধের দোকানই সহায় হয়েছিল ছোট্ট অ্যাঞ্জেলের বাবা দেবাশিসবাবুর। তিনি বলেন, “মেয়ের ওষুধ না পেয়ে সেই রাতে মনে হয়েছিল, এ আমরা কোন শহরে রয়েছি! হাসপাতালের নায্য মূল্যের ওষুধের দোকান তো ‘আই-ওয়াশ’ ছাড়া কিছু নয়। আমি আইআইটির নিরাপত্তারক্ষীদের অনেক অনুরোধ করে ওষুধ পেয়েছিলাম ঠিক। কিন্তু তার জন্য যতটা সময় গিয়েছে, মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে বিপদ হয়ে যেত।”
এক সময় খড়্গপুর শহরের মহকুমা হাসপাতাল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকান রাতে খোলা থাকত। বিপদের সময় কিছু দোকানে গিয়ে ডাকাডাকি করলে রাতে দরজা খুলে ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তবে মাস পাঁচেক হল সেই সব দোকানের ঝাঁপই রাতে বন্ধ থাকছে। রাতে দরকারে ডাকাডাকি করেও লাভ হচ্ছে না। এই অবস্থায় রাতে অন্তত কিছু ওষুধের দোকান খোলা রাখার দাবি তুলেছেন শহরবাসী। ঝাপেটাপুরের তলঝুলির বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী দিলীপকুমার চক্রবর্তী বলছিলেন, “আমার হাই ব্লাড প্রেসার। হামেশেই রাতে ওষুধের প্রয়োজন পড়েছে। কিন্তু ছেলে গিয়ে পায়নি। রাত রাত এগারোটার পরেই এমন অবস্থা। সমস্যার কথা ভেবে কিছু রাতে দোকান অন্তত রাতে খোলা রাখা উচিত।’’ সমস্যা অজানা নয় শহরের চিকিৎসকদেরও। চিকিৎসক সুপ্রিয় প্রামানিকের কথায়, “আগে কয়েকটা দোকান খোলা থাকলেও এখন থাকছে না। শীত আসছে। এই সময় শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগের সমস্যা বাড়ে। রাতে ওষুধের দোকান খোলা না থাকলে বিপদ বাড়বে।”
শহরবাসীর সমস্যা জানেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা। তবে তাঁদের দাবি, নিরাপত্তার অভাবেই রাতে দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের উল্টো দিকের একটি ওষুধ দোকানের মালিক অরুণ দণ্ডপাটের বক্তব্য, “রাতে দোকান খোলা থাকলে অনেক সময় মাদকাসক্তরা এসে ঘুমের ওষুধ, কাশির সিরাপ চায়। না দিলে দোকানে হামলা চালায়, হেনস্থা করে। কেউ কেউ আবার টাকা না দিয়ে পালিয়ে যায়। নিরাপত্তা না থাকলে আমরা কী ভাবে রাতে পরিষেবা দেব?” এক সময়ে রাতে দোকান খোলা রাখতেন এমন ওষুধের দোকানের মালিক অরুণ দুয়া, কর্মী সুকান্ত মান্নাদেরও একই বক্তব্য। তাঁদের কথায়, “আগে রাতে দোকান খুলে রাখতাম। তখন অনেকে জিনিস নিয়ে টাকা না দিয়েই পালাত। নেশাগ্রস্তরাও ভিড় করত। রাতে নিরাপত্তার অভাবে কর্মীরাও কাজ করতে চান না।’’ নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা হলে তাঁরা ফের রাতে দোকান খুলতে রাজি বলে জানিয়েছেন।
যদিও খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “খড়্গপুর শহরে হাসপাতাল, পুরাতনবাজার, কৌশল্যা, ইন্দা, খরিদায় রাতে পুলিশ পিকেট থাকেই। তাই নিরাপত্তার অভাবের অভিযোগ ঠিক নয়। ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ রাতে ওষুধ দোকান খোলার অনুমতি দেয়। সেই অনুমতি থাকলে দোকান খোলা রাখতেই পারেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা।’’ আর নায্য মূল্যের দোকানে অধিকাংশ ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরার বক্তব্য, “নায্য মূল্যের ওষুধ দোকানে নজরদারির জন্য হাসপাতালে একটি কমিটি রয়েছে। ওষুধ না পাওয়ার বিষয়টি আমি দেখব।’’