সেচের জলই পানীয় বহু এলাকায়

গরম পড়তেই বাড়ছে পানীয় জলের সঙ্কট। শুধু এ বার নয়, ফি বছরই গরমে পানীয় জলের সমস্যায় ভোগেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। জেলায় মোট জনসংখ্যা ৬৬ লক্ষ। প্রশাসনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলার মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এখনও জেলার প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষই পানীয় জল সরবরাহের আওতার বাইরে।

Advertisement

সুমন ঘোষ

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০০:২২
Share:

সঙ্কট মেটাতে সৌর বিদ্যুতের সাহায্যে জল প্রকল্প গড়ে উঠেছে ঝাড়গ্রামে। —নিজস্ব চিত্র।

গরম পড়তেই বাড়ছে পানীয় জলের সঙ্কট। শুধু এ বার নয়, ফি বছরই গরমে পানীয় জলের সমস্যায় ভোগেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। জেলায় মোট জনসংখ্যা ৬৬ লক্ষ। প্রশাসনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলার মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এখনও জেলার প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষই পানীয় জল সরবরাহের আওতার বাইরে। ফলে প্রতি বছর গরমে পানীয় জল সংগ্রহের জন্য নাজেহাল হতে হয় জেলার অধিকাংশ বাসিন্দাদের। পরিস্থিতি বদলাতে এ বার পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে আগাম নজরদারির উপর জোর দিচ্ছে প্রশাসন।

Advertisement

অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) পাপিয়া ঘোষ রায়চৌধুরীর কথায়, “মানুষকে যাতে তীব্র জল সঙ্কটে পড়তে না হয় সে জন্য চালু প্রকল্পগুলিতে নিয়মিত নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে। যে সব নতুন প্রকল্পগুলির কাজ চলছে সেগুলি দ্রুত শেষ করার জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘হঠাত্‌ কোথাও নলকূপ নষ্ট হলে যাতে দ্রুত তা মেরামত করা যায়, প্রয়োজনে যুদ্ধকালীন তত্‌পরতায় নতুন নলকূপ তৈরি করে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।” জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি (সিভিল) দফতরের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সুদীপকুমার সেনের কথায়, “সঙ্কট মেটাতে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। নতুন ৫০টি নলকূপ তৈরির সরঞ্জামও মজুত রাখা হয়েছে। জল পরীক্ষার কিটও মজুত রেখেছি। নির্মীয়মাণ প্রকল্পগুলির কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টাও করছি।”

বাস্তবের ছবিটা কি প্রশাসনের দাবির সঙ্গে মেলে?

Advertisement

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, পানীয় জলের জন্য সরকার জেলায় এখনও পর্যন্ত ৩৬ হাজার নলকূপ তৈরি করেছে। এ ছাড়াও জেলায় ১৭৭টি নলবাহিত পানীয় জল প্রকল্প চালু রয়েছে। নতুন আরও ৫২টি প্রকল্পের কাজ চলছে। যার মধ্যে ১৫টি প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। তবে সেগুলি এক মাসের মধ্যে চালু করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলি শেষ হতে ন্যূনতম ৬ মাস সময় তো লাগবেই। কিছুদিন আগে জঙ্গলমহলের ১১টি ব্লকে ছোট আকারে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে পানীয় জল প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। এ রকম ৪৫০টি প্রকল্প তৈরির অনুমোদন মিলেছিল। তার মধ্যে শেষ হয়েছে সাড়ে তিনশোটি। বাকি প্রকল্পগুলি আদৌ এ বার গ্রীষ্মের মধ্যে শেষ হবে কিনা সংশয় রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ পানীয় জলের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। জেলায় আরও ৬০টি বড় প্রকল্প তৈরির জন্য অনুমোদন চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলি মঞ্জুরও হয়েছে। যদিও এখনও অর্থ মেলেনি।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সদ্য অনুমোদন পাওয়া ৬০টি প্রকল্প ও কাজ চলা ৫২টি প্রকল্প শেষ হলেও জেলায় বড় জোর ২৬ শতাংশ মানুষকে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তাহলে জেলার একশো শতাংশ মানুষকে মানুষকে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করতে কতদিন লাগবে? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।

কেশপুরের বিলাসবাড়ের বাসিন্দা মধুসূদন দোলই বলেন, “গরম পড়লেই তীব্র জল-সঙ্কট দেখা দেয়। তখন গ্রামের নলকূপ বসে যায়। আশায় বসে থাকতে হয়, কখন সেচের জন্য ডিপ-টিউবওয়েল চালানো হবে। তারপর মাঠে গিয়ে জল ভরে আনতে হয়।” এই কারণে অনেক দিন ধরেই এলাকায় নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের দাবি জানিয়ে এসেছেন এলাকার মানুষ। যদিও এখনও সে দাবি পূরণ হয়নি। গড়বেতার বাঁশবেড়িয়া এলাকার শ্যামসুন্দর পাত্রের কথায়, “পানীয় জল বলতে নলকূপই ভরসা। কিন্তু গ্রীষ্মে জলস্তর নেমে গেলে নলকূপ থেকে জল পাওয়া যায় না। ঘন ঘন পাম্প করতে থাকলে প্রথমে সরু জল পড়তে থাকে। এক বালতি জল ভরতে হাত ব্যাথা হয়ে যায়। গরম বাড়লে সেটুকুও মেলে না। তখন সেচের জন্য ভরসা কেবল গভীর নলকূপই। কিন্তু তা তো মালিক মর্জি মতো চালায়। কিছু ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের অনুরোধে চালান ঠিকই, কিন্তু তাঁর তো বিদ্যুৎ খরচ হয়। অনুরোধই বা কত করা যায়।” তাই সকলেরই দাবি সরকারিভাবে নলবাহিত পানীয় জলের ব্যবস্থা করুক সরকার।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, পিছিয়ে থাকার পিছনে মূল কারণ পরিকল্পনার অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক একটি পাড়া বা গ্রাম ধরে ধরে ছোট ছোট পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রশাসনের একাংশের মতে, মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের হস্তক্ষেপেই এই প্রকল্পগুলি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এক একটি বড় প্রকল্প তৈরি করে পাশাপাশি ৪-৫টি গ্রামে জল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাহলে কম খরচে অনেক বেশি মানুষকে এই পরিষেবা দেওয়া যেত।

জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের আধিকারিকদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা করে এগোলে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় পানীয় জলের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, এই জেলার উপর দিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদী গিয়েছে। কাঁসাই, শিলাবতী ও সুবর্ণরেখা। ঝাড়গ্রাম মহকুমার পাশাপাশি খড়্গপুর মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকাতেও সুবর্ণরেখা থেকে জল তোলা সম্ভব। কাঁসাই নদী থেকেও ঝাড়গ্রামের একাংশ এবং মেদিনীপুর সদর ও খড়্গপুরের একাংশের জন্য জল সরবরাহ করা যাবে। শিলাবতী নদী থেকেও মেদিনীপুর সদর মহকুমার একাংশ ও ঘাটাল মহকুমায় জল সরবরাহ করা যায়। ঘাটাল মহকুমার একাংশে আবার রূপনারায়ণ থেকেও জল সরবরাহ সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে বাঁধ তৈরি জরুরি।

কাঁসাই নদীতে যেমন মোহনপুরের কাছে অ্যানিকেত তৈরি করা হচ্ছে তেমনি সুবর্ণরেখা ও শিলাবতীর দু’তনটি জায়গায় ওই পদ্ধতিতে বাঁধ তৈরি করে জল নিয়ে গেলে জেলার প্রতিটি জায়গাতেই জল সরবরাহ সম্ভব। তাছাড়াও কম জনবসতি সম্পন্ন যে সব ছোট গ্রামে এই ভাবে জল সরবরাহে খরচ বেশি সেখানে সৌর-বিদ্যুত্‌ ব্যবহার করলেই খরচ কমবে। তাতে বিদ্যুত্‌ খরচ নেই। আবার পাম্প চালানোর ঝক্কিও নেই। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ ব্যাপারে এ বার নতুন করে পরিকল্পনা তৈরি শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে জেলাকে পানীয় জলের সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে ওই পদ্ধতি ছাড়া গতি নেই। তবে তা কবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রশাসনিক আধিকারিকদের মতে, প্রকল্পগুলির কাজ না হওয়া পর্যন্ত জেলার কিছু মানুষকে জল সঙ্কট থেকে মুক্তি দেওয়া কঠিন। ফলে গ্রীষ্মে সাধারণ মানুষের জলের সমস্যা কিছুটা থাকবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন