রাজনীতির অঙ্কে যে সব সময়ে দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। তাই স্বস্তিতে নেই শাসক। ছবি: এএফপি।
আপাতদৃষ্টিতে ‘নিরাপদ’। সহজ পাটিগণিতের নিরিখে মেদিনীপুর বিধানসভা এলাকায় ধারেভারে এগিয়ে তৃণমূলই। তবে রাজনীতির অঙ্কে যে সব সময়ে দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। তাই স্বস্তিতে নেই শাসক। পঞ্চায়েত ভোটের পরে সেই অস্বস্তিতে যেন আরও বেড়েছে। শহরে ভোট কমা শুরু হয়েছিল। সেই হাওয়া গ্রামেও লেগেছে। বিজেপির ভোট যে বাড়তে শুরু করেছে তা মানছেন তৃণমূলের কট্টর সমর্থকেরাও। তবে তাঁদের যুক্তি, বামেদের ভোট বিজেপিতে যাচ্ছে।
সেদিন নির্বাচনী প্রচারে ভাদুতলার কাছে পিকআপ ভ্যানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন তৃণমূল প্রার্থী মানস ভুঁইয়া। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি পুরো শালবনি ঘুরছি। একটাও লাল পতাকা দেখতে পেলাম না। গেল কোথায় সিপিএম? তাহলে কি বুঝতে হবে সিপিএম থেকে বিজেপিতে গোপনে সরবরাহ করা হচ্ছে সমর্থক আর কর্মী!’’ সঙ্গে তাঁর আবেদন, ‘‘পঞ্চায়েতের কোনও ত্রুটি থাকলে পঞ্চায়েতের উপর রাগ করুন। কিন্তু আমাদের মা অন্নপূর্ণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর কোনও রাগ- অভিমান করবেন না।’’ এই সময়ের মধ্যে সিপিএমের অনেকে যে বিজেপিতে এসেছেন তা খোলাখুলি মানছেন মেদিনীপুরের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। দলের এক কর্মিসভায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘অনেকে নতুন নতুন এসেছেন। কেউ সিপিএম থেকে এসেছেন। কেউ কংগ্রেস, তৃণমূল থেকে এসেছেন। পুরনো দলের সংস্কার কিন্তু দ্রুত ভুলে যেতে হবে।’’
এই বিধানসভা এলাকার মধ্যে রয়েছে মেদিনীপুর পুর- এলাকা। সঙ্গে রয়েছে ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। এরমধ্যে ৪টি মেদিনীপুর সদর ব্লকের। বাকি ৫টি শালবনি ব্লকের। মেদিনীপুরে শেষ পুরভোট হয়েছে ২০১৩ সালে। শহরে ২৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। বোর্ড গড়তে প্রয়োজন ছিল ১৩টি আসন। ওই ১৩টি আসনই পেয়েছিল শাসক দল। বাকি ১২টি আসন দখল করেছিল বিরোধীরা। তারপর অবশ্য দলবদল হয়েছে। কংগ্রেস কাউন্সিলর, এমনকি বাম- সমর্থিত কাউন্সিলরও তৃণমূলে এসেছেন। ২০১৩ সালেও নির্ধারিত সময়ে পুরভোট হয়নি। পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরনোর পরে প্রশাসক বসাতে হয়েছিল। এ বারও তাই। শহরে এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। বিজেপির জেলা সম্পাদক অরূপ দাসের দাবি, ‘‘হেরে যাওয়ার ভয়েই এখানে তৃণমূল পুরভোট করায়নি।’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সারদা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নতুন বোর্ড ক্ষমতায় আসুক।’’ প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৌমেন খান বলেন, ‘‘ভোট হলে শাসক দলের ভরাডুবি নিশ্চিত। তাই এখানে পুরভোট করা হচ্ছে না।’’ মেদিনীপুরের তৃণমূল বিধায়ক মৃগেন মাইতির অবশ্য বক্তব্য, ‘‘পুরভোট কখন হবে তা নির্বাচন কমিশনের বিষয়।’’ তাঁর দাবি, পুর- পরিষেবায় কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল প্রার্থী বাম প্রার্থীর চেয়ে ৩৯ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর থেকে ৩২,৯৮৭ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তৃণমূলের মৃগেন মাইতি। তিনি পেয়েছিলেন ১,০৬,৭৭৪ ভোট। বাম প্রার্থী সন্তোষ রাণা পেয়েছিলেন ৭৩,৭৮৭ ভোট। বিজেপি প্রার্থী তুষার মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ২২,৫৬৭ ভোট। তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল বিজেপি। রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এই সময়ের মধ্যে মেদিনীপুরে সেই বিজেপিই দ্রুত এগিয়েছে। লড়াই তাই এ বার হবে সেয়ানে- সেয়ানে। ২০১৮ পঞ্চায়েত ভোটে মেদিনীপুর সদর ব্লকের ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে চাঁদড়া এবং ধেড়ুয়া দখল করেছে বিজেপি। মণিদহ এবং কনকাবতী তৃণমূলের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে, শালবনির ৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত যথাক্রমে কর্ণগড়, গড়মাল, সাতপাটি, বাকিবাঁধ এবং কাশীজোড়া তৃণমূলের দখলে রয়েছে। তবে বেশ কিছু সংসদে তৃণমূলের ফল তুলনায় খারাপ হয়েছে। কোনও রকমে গড়মাল পঞ্চায়েত দখলে রেখেছে শাসক। গড়মাল, সাতপাটির কিছু গ্রামে পদ্মফুল ফুটেছে।
নির্বাচনী প্রচারে জায়গা করে নিয়েছে কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ। বিরোধীদের অভিযোগ, ছোট- মাঝারি কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিয়েছেন মানুষ। নতুন করে কর্মসংস্থানের বন্দোবস্তও হয়নি। মেদিনীপুরের বিধায়ক মৃগেন মাইতি অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, ‘‘এই সময়ের মধ্যে ছোট- মাঝারি শিল্পে অনেক কর্মসংস্থান হয়েছে।’’ চাঁদড়ার জঙ্গল থেকে শালপাতা তুলে ফিরছিলেন লক্ষ্মীরানি মাহাতো। ভোটের হালচাল কেমন? লক্ষ্মীরানি বলছিলেন, ‘‘আমাদের আবার ভোট! ১ হাজার পাতা বিক্রি করলে ২০০ টাকা পাই। সেই দিয়েই সংসার চালাতে হয়। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাঁটুনির পরে আর ভোটের কথা ভাবার সময় কোথায়!’’