মন্ত্রোচ্চারণ নয়, চোখের মিলনেই পরিণয় ডোরে নীরব প্রেম

বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়াই বিয়ের পিড়িতে বসলেন দু’জন—দেব কুমার মাইতি ও মৌমিতা বেরা। দু’জনের সাতপাকে বাঁধা পড়ার ঘটনা অনেকটাই  রণবীর কাপুর আর প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘বরফি’ ছবির কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সুতাহাটা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৮ ০১:১৫
Share:

বিয়ের পিঁড়িতে মৌমিতাকে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন দেবকুমার। নিজস্ব চিত্র

একজন মুখ ফুটে কথা বলতে পারেন না। আর একজনের কানে পৌঁছয় না জাগতিক কোনও শব্দ। তবে পড়াশোনা, খেলাধুলো-সহ দৈনন্দিন জীবন এঁদের কেটেছে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই। দুজনেই জাতীয় স্তরে সাঁতার ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এ বার দু’জন বাঁধা পড়লেন ‘সাত পাকে’।

Advertisement

বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়াই বিয়ের পিড়িতে বসলেন দু’জন—দেব কুমার মাইতি ও মৌমিতা বেরা। দু’জনের সাতপাকে বাঁধা পড়ার ঘটনা অনেকটাই রণবীর কাপুর আর প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘বরফি’ ছবির কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

হলদিয়া মহকুমার সুতাহাটার রঘুরামপুরের বাসিন্দা দেবকুমার আর বাহারডাবের বাসিন্দা মৌমিতার বিয়েছে রবিবার সাক্ষী থাকলেন রইল তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরের শতাধিক ভক্ত আর স্থানীয় মানুষ। চারহাত এক করতে যাঁরা উদ্যোগী হয়েছিলেন সেই ‘রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী’র তরফে জানানো হয়েছে, পাঁচ বছর বয়সে হলদিয়ার বাড়ঘাসিপুরে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন মৌমিতা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার পর থেমে গিয়েছিল যুদ্ধ। তারপর প্রায় অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল জীবন। মৌমিতার বাবা পেশায় দিনমজুর পার্থসারথি বেরা বলেন, ‘‘মেয়ের মুখ ফুটত না, তাই জন্ম থেকে তাকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় থাকতাম। পড়ার পর অন্য মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে! এই আশঙ্কাতে কাটত সংসার।’’ এরপর হঠাৎই একটি সংস্থার তরফে যোগাযোগ করা হয় মৌমিতার পরিবারের সঙ্গে। হলদিয়ার ব্রজলালচকে ওই সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, মেয়েটি আপাতত সেখানে টেলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। একই জায়গায় অটোমোবাইলের কাজ শিখে স্ব-নির্ভর হতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দেবকুমারও। জন্ম থেকেই কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই যোগাযোগ। এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে পাকাপাকি হয়।

Advertisement

এদিন দুই পরিবারের লোকজনই উপস্থিত ছিলেন বিয়ের আসরে। বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলেও মন্ত্রোচ্চারণেও কোনও উপায় নেই। কিন্তু তাতে দুই মনের এক সূত্রে বাঁধা পড়তে কোনও বাধা হয়নি। মন্দিরের পুরোহিতের পরামর্শে বিয়ের মাঙ্গলিক মন্ত্র উচ্চারণ করেন মৌমিতার মা। বিয়ের পরে ছিল আমন্ত্রিতদের জন্য ভুরিভোজ।

কলকাতা থেকে বর্গভীমা মন্দির ঘুরতে এসেছিলেন জনা ১৩ মহিলার একটি দল। তাঁদের কথায়, ‘‘পুজো দিতে এসে এমন বিয়ের অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে পেরে খুব ভাল লেগেছে। মন্দিরে আসা অলিম্পিয়া দাস ও অনিতা পালিতের মতো দর্শনাথীরা বলেন, ‘‘এতদিন বিয়ের আসরে মন্ত্র শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু শুধু চার চোখের মিলনে নিঃশব্দে যে অটুট বন্ধনে বাঁধা পড়া যায় তা এঁদের না দেখতে বোঝা যেত না। এই অভিজ্ঞতা দুর্লভ।’’

সংস্থার তরফে পান্নালাল দাস বলেন, ‘‘আগেও এমন বিয়ে হয়েছে। এবার ছেলে–মেয়ের বাড়ির সম্মতি নিয়ে দুজনকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে দেওয়া হল।’’

দেবকুমারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের আধিকারিক চিত্তরঞ্জন মাইতি বলেন, ‘‘দুই ছেলেই প্রতিবন্ধী। কিন্তু দেবকুমারের জন্য এমন পাত্রী পাব ভাবিনি। ওঁরা নতুন জীবন প্রবেশ করায় গোটা পরিবার খুব খুশি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন