রাস্তায় দাপট কুকুরদেরই। ঝাড়গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।
বছর ছাব্বিশের শিক্ষক বিশ্বজিৎ কর্মকার, বই বিক্রেতা চল্লিশের চন্দন দত্ত বা বিরাশি বছরের চিকিৎসক সাধুচরণ পাত্রের মধ্যে মিল এক জায়গাতেই। ভোরে ঘুরতে যাওয়ার সময় সকলের সঙ্গী লাঠি।
কারণ কি? জানতে চাওয়ায় বিরক্তি ভরা উত্তর, ‘‘রাস্তায় তো আর আমরা হাঁটি না। দাপট কুকুরদের। তাদের ঠেকাতেই এই অস্ত্র।’’
এটা শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সব এলাকারই ছবিটা এখন এটাই। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের কথাই ধরা যাক। দিন কয়েক আগেই রাতে আঁকা শিখে বাড়ি ফেরার পথে কুকুরের কামড়ে জখম হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সৃজা। তারপর জেলা হাসপাতালে গিয়ে ইঞ্জেকশন নিয়ে তবে রেহাই। কিন্তু তারপরও আতঙ্ক কাটেনি বছর দশেকের ছোট্ট মেয়েটির। দুই জেলারই এলাকারবাসীর অভিযোগ, দিনে দিনে কুকুরের সংখ্যা বাড়ছে রাস্তায়। আর এই কুকুরের দাপটে রাস্তায় হাঁটাচলা মুশকিল। শুধু তাই নয়, শহরের বহুতল আবাসনগুলির গ্রিল কিংবা দরজার ফাঁক গলে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ঘরে উঠে সংসার পেতে ফেলছে তারা। সারা শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে অসুস্থ কুকুরগুলো দোতলা কিংবা তিনতলা বাড়ির নিরাপদ সিঁড়ির কোণে শুয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। এই বিষয়ে পুরসভার কোনও হেলদোল নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, ঝাড়গ্রাম পুর এলাকার ওয়ার্ড ১৮টি ওয়ার্ডে কম করে ৪০-৫০ টা বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, শহরে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ জন কুকুরের কামড়ে জখম হন। গত ছ’মাসে ২৫৮ জনকে অ্যান্টি রেবিস ভ্যাকসিন দিতে হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরক্তিটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা অন্য কোথাও।
অধিকাংশ বাসিন্দাদের অভিযোগের তির পুরসভার দিকেই। শহরে কুকুরের সংখ্যা কত তার নির্দিষ্ট তথ্যও নেই কোনও পুরসভার হাতে। আর কুকুরদের নির্বীজকরণ বা বন্ধ্যাত্বকরণের যে দায়িত্ব প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের নেওয়া প্রয়োজন, তাই বা নেওয়া হয় না কেন? সমস্যার কথা মেনে নিয়ে তমলুকের পুরপ্রধান রবীন্দ্রনাথ সেন বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও পুরসভার পক্ষ থেকে কুকুর মারার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হত। তবে বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠনগুলির আপত্তির জেরে এখন সেই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না।’’ কিন্তু প্রাণী হত্যার বদলে কুকুরের নির্বীজকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না কেন? রবীন্দ্রনাথবাবুর উত্তর, ‘‘আমাদের পুরসভায় এমন পরিকাঠামো নেই। এ বিষয়ে প্রাণীসম্পদ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের সাহায্য চাওয়া হবে।’’ ঝাড়গ্রামের উপপুরপ্রধান শিউলি সিংহর কথায়, ‘‘কিছু একটা করতে হবে।’’
পথ কুকুরদের দাপটে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন মেদিনীপুর-খড়্গপুর দুই শহরের বাসিন্দারাও। মেদিনীপুরে এক সময় পুরসভার উদ্যোগে কুকুর ধরার গাড়ি (ডগ ক্যাচার) কেনা হয়েছিল। টিকাকরণের কাজ শুরু হয়েছিল। ক্রমে সব উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ডগ ক্যাচারও আর সচল নেই। সমস্যা স্বীকার করেও মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “এক সময় কুকুর ধরে শহরের বাইরে ছেড়ে দেওয়া হত। এখন ওই সব এলাকাতেও বসতি গড়ে উঠছে। ফলে, তার আর উপায় নেই।’’ কিন্তু নির্বীজকরণ তো সম্ভব? এ বার পুরপ্রধানের জবাব, “শহরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কুকুরের নির্বীজকরণ করে। তাদের পুরসভা সহায়তা করে। তবে এটা আরও বড় আকারে করতে হবে। দেখছি কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’
কাঁথি মহকুমা পশু হাসপাতালের সহ অধিকর্তা বিষ্ণুপদ মান্না জানান, জেলা প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতর, কাঁথি পুরসভা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৮০টি পুরুষ কুকুরের নির্বীজকরণ ও ৮৫টি মেয়ে কুকুরের বন্ধ্যাত্বকরণ অস্ত্রোপচার করা হয়। কাঁথি শহরে পশুদের নিয়েই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালান শিক্ষিকা শোভনা সেন। তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে আমরা রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজ করছি। মাসে মাসে কুকুরদের কৃমির ওষুধ খাওয়ানো, পোকার ওষুধ দেওয়া, কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার দায়িত্ব আমরা নিই।’’ সঙ্গে তাঁর সংযোজন, এলাকার বাসিন্দাদেরও এক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য প্রয়োজন। অনেক জায়গায় স্থানীয়রা নিজেরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকার কুকুরদের দেখভাল করে থাকেন। সেই ব্যবস্থা করতে পারেন অনেকেই।
কুকুর ধরার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যা মানছেন একাংশ পুরকর্তাও। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা নেই।’’ শহরে এমন কুকুরও রয়েছে, যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কারও গায়ে ঘা, কারও লোম উঠে গায়ে লালচে দাগ পড়েছে। বেশ কিছু কুকুরের স্বাস্থ্য ভাল নয়। এই ধরনের কুকুরের রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুর-কর্তা মানছেন, “প্রায় সব কুকুরই কৃমিতে আক্রান্ত। এদের ওষুধ খাওয়ানো দরকার। বিস্কুট বা মিষ্টিতে ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভ্যাকসিনও দেওয়া যেতে পারে।’’ কিন্তু সেই সব উদ্যোগ চোখে পড়ে কই?