বিরোধীদের প্রতিরোধ কই, প্রশ্ন কাঁথিতে

পর পর তিনবার। পুরভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিলেন বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী ও পুরপ্রধান সৌমেন্দু অধিকারী। আর ভোটের পর ফল বেরোতে দেখা গেল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০১৫ সালের পুর-নির্বাচনে ফের বিরোধীশূন্য থাকল কাঁথি পুরসভা।

Advertisement

সুব্রত গুহ

কাঁথি শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০০:২১
Share:

পর পর তিনবার।

Advertisement

পুরভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিলেন বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী ও পুরপ্রধান সৌমেন্দু অধিকারী। আর ভোটের পর ফল বেরোতে দেখা গেল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০১৫ সালের পুর-নির্বাচনে ফের বিরোধীশূন্য থাকল কাঁথি পুরসভা।

পুরভোটের প্রচার চলাকালীন বারবার শহরের বাসিন্দার কাছে বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড গড়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তা সত্যি করে দিয়েছে পুরভোটের ফল। ভোট-পর্বে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ ছিল, কাঁথিতে সন্ত্রাস ও আতঙ্কের আবহ তৈরি করে রেখেছে তৃণমূল। তাই আপাত শান্তির এই নির্বাচন প্রহসন মাত্র। আবার সিপিএমের একটা অংশের বক্তব্য ছিল, গোটা বিষয়টাই বিজেপি ও শাসক দলের গোপন সমঝোতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিপিএম কর্মীর কথায়, ‘‘কাঁথিতে বিরোধী শূন্য পুরসভা গঠনের জন্য সিপিএম ও বিজেপির কিছু জেলা থেকে স্থানীয় নেতা তৃণমূলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেছেন। আর তার ফলও মিলেছে।’’

Advertisement

জাতীয়তাবাদী এলাকা হিসেবে পরিচিত কাঁথিতে বামেরা চিরকালই সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। কিন্তু তা বলে কাঁথিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধী প্রার্থীই যে মিলবে না এমনটা গণতন্ত্রে কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রশ্ন হল, শাসকদলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাজ্য জুড়ে পথে নেমেছিল বামেরা। যদি ধরেও নেওয়া হয় কাঁথিতে শাসকদল তৃণমূলের চাপা সন্ত্রাস রয়েছে, তার জন্য কী প্রতিরোধ গড়ে তুললেন জেলার সিপিএম নেতারা? পরিসংখ্যান বলছে, পুরভোটের আগে অন্য দিকে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তাপস সিংহ দু’দিন কাঁথিতে এসে ৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকটি বাড়িতে সামান্য প্রচার করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। দলের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি ও রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য রবীন দেব গত ৯ এপ্রিল কাঁথিতে এসে দলীয় কার্যালয়ের সামনে একটি কর্মিসভা করলেও কোনও সভা বা প্রচারাভিযানে যোগ দেননি।

বিজেপি, কংগ্রেসের ছবিটা প্রায় একই। বিজেপির তরফ থেকে ভোটের সময় একটিও মিছিল বা পথসভা করা হয় নি। শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের লড়াইটাই সাজানো ও গড়াপেটা বলেও অভিযোগ করেছেন কাঁথি পুরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সন্দীপ নন্দ। তাঁর অভিযোগ, “আমাকে শাসক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে জোরদার করতে দেওয়া হয়নি। বিজেপির কাঁথি নগরমণ্ডলের এমন অসহযোগিতা নিয়ে আমি দলের জেলা সভাপতি তপন করের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। এমনকী আমার হয়ে কেউ প্রচারেও আসেননি।’’

উল্টো দিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী সারা রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের প্রচারের ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও কাঁথিতে ৬টি নিবার্চনী সভা করেছেন। কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর নিজে ওই সভাগুলিতে থাকা ছাড়াও শিশিরবাবু নিজে ৫টি সভা করেছেন। নিজের গাড়ি ছেড়ে রিকশায় চড়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়েছেন। এছাড়াও বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী ও পুরপ্রধান সৌমেন্দু অধিকারী গোটা কাঁথি পুরনিবার্চন পরিচালনা করার ভার নিজেদের কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অগুনতি পাড়া বৈঠক, বাড়ি বাড়ি প্রচার, মিছিল করা ছাড়াও প্রচারের শেষ দিনে কাঁথি শহর জুড়ে মহামিছিল পর্যন্ত বার করেছেন।

কেন প্রতিরোধের হাল এমন? কাঁথি পুর-নিবার্চনের দায়িত্বে থাকা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য চক্রধর মেইকাপের কথায়, “বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে কাঁথির ২১টি ওয়ার্ডেই প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। ১৪টি ওয়ার্ডে সিপিএম ও সিপিআই দলের প্রতীকে ও বাকি ৭টি ওয়ার্ডে বাম সমর্থিত নিদর্ল প্রার্থী হিসেবে।’’ প্রচারে কেন জোর দেওয়া হল না? তাঁর সাফাই, ‘‘সাধারণ মানুষকে যাতে আতঙ্ক আর ভয়ভীতি ও হুমকির শিকার না হতে হয়, তার জন্যই প্রকাশ্য সভা, মিছিল না করে বাড়িবাড়ি প্রচারের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।” বিজেপির জেলা সভাপতি তপনকান্তি কর অবশ্য সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর সাফাই, ‘‘ওই পুরসভায় এমন কিছু লোককে প্রার্থী করা হয়েছিল, যাঁদের কোনও জনসংযোগই নেই। তাই বড় নেতাদের নিয়ে গিয়ে সেখানে হাসির খোরাক হতে চাইনি আমরা।’’

ভোটের ফল বলছে, তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ২৪,১৯১ ভোট অর্থাৎ (৬৬.৫৩ শতাংশ)। পুরসভার ১৯টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্টের প্রতীকে ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ৪০২৮ (১১.০৭ শতাংশ)। এর মধ্যে সিপিএম ১২টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রাপ্ত ভোট ৩৭৯২ (১০. ৪২শতাংশ) সিপিআইয়ের ২টি আসনে প্রাপ্ত ভোট ২৩৬ (.০৬৪ শতাংশ)। বিজেপির ১৫টি আসনে প্রাপ্ত ভোট ৩৯২৯ (১০.৮০ শতাংশ) কংগ্রেসের ১১টি আসনে প্রাপ্ত ভোট ৫৫২ (১.৫৪ শতাংশ)। ৮ জন নির্দল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৩৬৬১ (১০.০৬ শতাংশ)। বামফ্রন্টের ৭, বিজেপির ৩ আর কংগ্রেসের ১১জন প্রার্থীরই জামানত জব্দ হয়েছে।

জেলা তৃণমূল সভাপতি শিশির অধিকারীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তৃণমূল নিজস্ব শক্তিতেই কাঁথিতেই নিবার্চন জেতে। তৃণমূল ছাড়া আর সব দলই জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন। উন্নয়নের স্বার্থেই তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন মানুষ। বিরোধীহীন পুরসভা কাঁথিতে এবারই প্রথম নয়, বামফ্রন্টের জমানাতেও তৃণমূল দু দু’বার বিরোধীশূন্য পুরসভা গঠন করেছিল।”

এত কিছুর পরও অবশ্য হাল ছাড়তে নারাজ সিপিএম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘জেলা সিপিএমের নেতাদের কাথিতে সভা করার জন্য ডাকাই হয়নি। তবে আগামী ৭ মে তমলুকে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে ঝড় উঠবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন