দিদি যেখানে ‘সব কিছু বুঝে নেওয়ার’, ‘উত্তর দিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিচ্ছেন, সেখানে তাঁর ভাইয়েরা আর হাত- পা গুটিয়ে বসে থাকেন কী করে!
তাই এ বার মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের টেলিভিশন বন্ধ রাখার নতুন ফতোয়া। বিরোধীদের অভিযোগ, টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেলে শাসক বিরোধী খবর দেখে যদি কেউ প্রভাবিত হন, তাই আর ভাইয়েরা ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
মূলত কারারক্ষীরাই জেলের টিভি দেখেন। টিভিতে প্রায় সময়ই খবরের চ্যানেলই চলে। এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না শাসকদলের কারারক্ষী সংগঠন। মঙ্গলবার সংগঠনের কয়েকজন সদস্য জেল সুপারের রুমে চড়াও হয়ে ওই টিভি বন্ধ রাখার দাবি জানায়। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন তৃণমূল প্রভাবিত কারারক্ষী সংগঠন বঙ্গীয় কারারক্ষী সমিতির মেদিনীপুর সার্কেল কমিটির সম্পাদক কার্তিক সাহু।
জেলের এক সূত্রে খবর, সমিতির এক নেতা রীতিমতো টেবিল চাপড়ে সুপারকে বলেন, “এ সব কী হচ্ছে? চ্যানেলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে খবর দেখাচ্ছে। আর সেই খবর সকলকে দেখতে হবে! এখনও ক্ষমতায় আমরাই আছি! এ সব মেদিনীপুরে করতে দেব না!” সমিতির নেতার দাবি শুনে প্রথমে ঘাবড়েই যান সুপার। গোড়ায় না কী তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘কী হয়েছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ পরে তিনি না কী বলেন, ‘ওহ! এই ব্যাপার! এতে এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে! আমি দেখে নিচ্ছি! টিভিটা বন্ধ রাখলেই তো হল!’
সমিতির নেতাদের কথা মতো জেলের টিভি বন্ধ রাখার নির্দেশও দিয়ে দেন সুপার! জানিয়ে দেন, এখন টিভি বন্ধ থাকবে! যা শুনে এক কারারক্ষীর মন্তব্য, “প্রশাসন কী ভাবে চলছে বেশ বোঝা যাচ্ছে! উর্দির মান থাকছে না! শিরদাঁড়া সোজা থাকলে এটা হত না!” তাঁর কথায়, “এরপরে যদি কোনও নেতা এসে সুপারকে বলেন, কাল থেকে আপনি এই রুমে বসবেন না, ওই রুমে বসবেন, সুপার কী তাও শুনবেন!”
যাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের দল সুপারের রুমে চড়াও হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই কার্তিকবাবু এ দিন বলেন, ‘‘কারারক্ষীদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছিল। তাই টিভি বন্ধ রাখার কথা বলেছি।’’ অবশ্য সংগঠনের এক নেতা মানছেন, “সুপারের কাছে টিভি নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। এটা বড় কোনও ব্যাপার নয়! কেউ চড়াও হয়নি! কয়েকজন গিয়ে শুধু সংগঠনের দাবিই জানিয়ে এসেছেন! ১৯ মে ভোটের ফলাফল। ওই দিন পর্যন্ত টিভি বন্ধ থাকলে আপত্তির কী আছে!”
তৃণমূলের কারারক্ষী সংগঠনের নেতারা যে তাঁর কাছে এসে টিভি বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন, তা ঘুরিয়ে মানছেন জেল সুপার স্বরূপ মণ্ডলও। তৃণমূলের সংগঠন কী জেলের টিভিতে খবরের চ্যানেল চলা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে? জেল সুপার স্বরূপবাবুর জবাব, “জেলের গেটে একটা টিভি আছে। টিভিতে সব সময়ই খবর হচ্ছে তো। খবরটা অনেকেই দেখছে। দেখে নানা রকম মন্তব্য করছে। তাতে কিছু কিছু লোক বলছে, এখন ‘ইলেকশন’ চলছে। ‘ইলেকশনের’ সময় এই ধরনের মন্তব্য তো ঠিক নয়।” এরপর তাঁর সংযোজন, “তাই আমি বলেছি, তাহলে টিভি বন্ধই থাক!”
বাম- আমলে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে তৃণমূলের সংগঠনের তেমন প্রভাব ছিল না। আরএসপি এবং সিপিএমের সংগঠনেরই প্রভাব ছিল। ছবিটা বদলায় রাজ্যে পালাবদলের পরে। এখন মেদিনীপুর জেলে তৃণমূলের সংগঠনের একচ্ছত্র দাপট। কোন ওয়ার্ডে কাকে রাখা হবে, কখনও কখনও তাও তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের নেতাদের কথায় হয় বলে অভিযোগ। বঙ্গীয় কারারক্ষী সমিতির মেদিনীপুর সার্কেল কমিটির সম্পাদক কার্তিক সাহুর দাপটও কম নয়। কখনও পরীক্ষা চলাকালীন জেল ক্যাম্পাসে মাইক বাজিয়ে সভা করে, কখনও জেল- কর্তাকে শাসানি দিয়ে এর আগেও তিনি বিতর্কে জড়িয়েছেন।
টিভি নিয়ে সমিতির এক নেতার বক্তব্য, “আমরা আগে একজন কর্মচারী। তারপর সংগঠক! টিভির খবরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কত কথা বলা হচ্ছে! কেউ কেউ বলছেন, তৃণমূল না কি ক্ষমতায় ফিরবে না! টিভি না চললে তো এ সব আলোচনার সুযোগ নেই!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তাছাড়া, জেলের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা হবে কেন! কর্মচারী হিসেবেই সংগঠনের কয়েকজন সুপারের কাছে গিয়ে টিভি বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে এসেছেন। সুপার টিভি বন্ধ রাখার নির্দেশও দিয়েছেন। এতে অন্যায়ের কী আছে!”
জেলের এক কর্মীও বলছিলেন, “দিদি যেখানে ‘সব কিছু বুঝে নেওয়ার’, ‘উত্তর দিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দেন, সেখানে ভাইয়েরা তো বুঝে নেবেন, দেখে নেবেনই! সুপার আর কী করবেন!”