হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট। ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল (ইনসেটে)। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
ঘটনা-১। বছর খানেক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী কৌশিক সিংহ। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে ওই সময় ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট’ (সিসিইউ) না থাকায় কৌশিকবাবুকে কলকাতায় রেফার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করিয়ে আপাতত সুস্থ তিনি।
ঘটনা-২। ১১ জানুয়ারি ২০১৬। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে সিসিইউ (‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট’) চালু হয়। ঘটনাচক্রে, কয়েকদিন পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ঝাড়গ্রাম শহরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মালা সেনরায়। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের সিসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। মালাদেবীকে ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাও করা হয়। কিন্তু হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ না-থাকায় তাঁকেও রেফার করা হয় কলকাতায়। এনআরএস হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পরে কার্যত পুনর্জন্ম হয়েছে মালাদেবীর।
ঘটনা-৩। মাস খানেক আগে বুকে ব্যথা অনুভব করেন বেলপাহাড়ির আলোকি মাণ্ডি। রেফার হয়ে কলকাতায় যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় ওই মহিলার।
তাহলে সব মিলিয়ে ছবিটা দাঁড়াল এমন, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট’ (সিসিইউ) থাকা সত্ত্বেও এখানে হৃদরোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই হয় না। তাই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করেই রেফার করে দেওয়া হয় কলকাতায়। এর কারণ কী?
জানা গিয়েছে, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে কোনও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। নেই হৃদরোগের চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো (ক্যাথ ল্যাব) ও টেকনিশিয়ান। হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো হল ক্যাথ ল্যাব ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় অ্যাঞ্জিওগ্রাম, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি এবং হৃৎপিণ্ডের ত্রুটি নিরাময়ের ব্যবস্থা থাকে। ক্যাথ ল্যাব ব্যবস্থায় বুকে পেসমেকার বসানোর জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোও থাকে। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল এবং সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ক্যাথ ল্যাব-এর কোনও পরিকাঠামো নেই। তাই বাধ্য হয়ে সিসিইউ-তে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে হৃদরোগীদের রেফার করে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ১১ জানুয়ারি সিসিইউ চালু হওয়ার পরে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ৫৩ জন হৃদরোগীকে কলকাতায় রেফার করা হয়েছে।
কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয় তো! ঝাড়গ্রামকে পৃথক জেলা করার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী আগেই। সেই সূত্রেই মহকুমা জেলা হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে এই হাসপাতাল। আর শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকের পাশাপাশি, পার্শ্ববর্তী বাঁকুড়ার ফুলকুসমা ও রাইপুর এলাকা এবং সীমানাবর্তী পূর্ব সিংভূম ও ওড়িশার বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দারা ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। তারপরও কেন এই হাসপাতালে কোনও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নেই? কেনই বা নেই হৃদরোগের চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো (ক্যাথ ল্যাব) ও টেকনিশিয়ান?
ঝাড়গ্রাম থেকে সড়কপথে কলকাতার দূরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার। রেফার হওয়ার পরে অ্যাম্বুল্যান্সে প্রায় ঘন্টা চারেকের যাত্রাপথের ধকলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন রোগীরা। সময়মতো চিকিৎসা না হওয়ায় কলকাতায় নিয়ে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, হৃদরোগীদের জন্য চিকিৎসা-পরিভাষায় ‘গোল্ডেন আওয়ার’ হল মাত্র আধ ঘন্টা থেকে বড় জোর এক ঘন্টা। কিন্তু সঙ্কটাপন্ন রোগীদের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে প্রকৃত চিকিৎসা শুরু হচ্ছে অনেক পরে। সেই কারণে কলকাতায় যাওয়ার পথেই মৃত্যু হচ্ছে অনেক রোগীর।
ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট বেসরকারি চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, “মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের কোনও সরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিত্সার ব্যবস্থা নেই। জঙ্গলমহলবাসীর স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ করলে সকলে উপকৃত হবেন।” আর ঝাড়গ্রামের সিএমওএইচ অশ্বিনীকুমার মাঝি বলেন, “বিভিন্ন সময়ে বাসিন্দারা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।”