চোরাবালিতে মরণ-ফাঁদ, বিপন্ন নদীও

নদীর বুক থেকে চুরি যাচ্ছে বালি। দিনেদুপুরে মেশিন চালিয়ে চলছে বেআইনি কারবার। অভিযোগ, প্রশাসন দেখেও দেখে না অবৈধ এই ব্যবসা। সত্যি কি তাই— খোঁজ নিল আনন্দবাজার।নদীর বুক থেকে চুরি যাচ্ছে বালি। দিনেদুপুরে মেশিন চালিয়ে চলছে বেআইনি কারবার। অভিযোগ, প্রশাসন দেখেও দেখে না অবৈধ এই ব্যবসা। সত্যি কি তাই— খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১৭
Share:

গ্রাসে: দেদার বালি তোলায় ভাঙছে কংসাবতী নদীর পাড়। মেদিনীপুরের ধেড়ুয়াতে। ছবি: কিংশুক আইচ

যথেচ্ছ বালি তোলার ফলে বিপন্ন পশ্চিম মেদিনীপুরের নদীগুলি। নদীখাতে যত্রতত্র গর্ত তৈরি হয়েছে। চোরা বালিতে ঢুকে গিয়ে মৃত্যুর নজিরও রয়েছে।

Advertisement

বছর কয়েক আগে দুপুরে স্নান করতে গিয়ে কংসাবতীর চোরাবালিতে ঢুকে যান মধ্য তিরিশের অচিন্ত্য দাস। তাঁর বাড়ি ছিল মেদিনীপুর শহরতলিতে। পরে নদীর জলেই দেহ ভেসে ওঠে ওই যুবকের। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, রেলব্রিজ সংলগ্ন এলাকা- কালগাং- পালবাড়ি থেকে মোহনপুর- মাতকাতপুর, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবৈধ ভাবে বালি তোলা চলে। প্রশাসন সব জেনেও নীরব। বছর কয়েক আগে শহরের দ্রৌপদী সিংহ নামে এক মহিলা চোরা বালিতে ঢুকে মারা যান। রেলব্রিজের কাছে পিকনিক করতে এসে তিন বন্ধুর জলে তলিয়ে মৃত্যু হয়।

একই ভাবে কয়েক বছর আগে ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রামে সুবর্ণরেখায় স্নান করতে গিয়ে চোরাবালিতে মৃত্যু হয় আইআইটি খড়্গপুরের এক ছাত্রের। গত বছর ফের নয়াগ্রামের একই জায়গায় স্নান করতে গিয়ে সুবর্ণরেখায় তলিয়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল কেশিয়াড়ি পলিটেকনিকের এক ছাত্রের। অভিযোগ, একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকলেও হুঁশ ফেরেনি প্রশাসনের। মেদিনীপুর শহরের কাউন্সিলর সৌমেন খান মানছেন, “অবৈধ ভাবে বালি তোলা বন্ধ না-হওয়ার জন্য কখনও কখনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নদীর আশপাশে যথেচ্ছ গর্ত তৈরি হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়েন।”

Advertisement

বালি বোঝাই লরির ধাক্কায় মৃত্যুও হচ্ছে আকছার। মাস কয়েক আগে মেদিনীপুর সদর ব্লকের গুড়গুড়িপালে বালি বোঝাই লরির ধাক্কায় এক যুবকের মৃত্যুর পরে এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। একের পর এক বালি বোঝাই লরিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। স্থানীয় বাসিন্দা জয়দেব ভুঁইয়ার কথায়, “প্রায় দিনই দুর্ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বালি বোঝাই লরিই পথচারীদের ধাক্কা মারে।” গুড়গুড়িপাল হাইস্কুলের ছাত্র রাকেশ দোলুই, মনমোহন দোলুই, তারক বিশুই, রুদ্র রাউলদের কথায়, “লরিগুলো খুব জোরে চলে। যে কোনও সময় ধাক্কা দিতে পারে।’’ গত বছর ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ায় বালিবাহী বেপরোয়া লরির ধাক্কায় এক সব্জি বিক্রেতার মৃত্যুর পরে আবার পথ অবরোধ করেছিলেন এলাকাবাসী।

গত বছর জুলাইয়ে ডেবরার চকাশ্রব ও হরিদ্রাপাটে বালি বোঝাই দশ-বারোটি ট্যাক্টর আটকে বিক্ষোভ দেখিয়ে ছিল স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ ছিল, অবৈধ ভাবে বালি পরিবহণের ফলে বেহাল হচ্ছিল মাড়তলা-ঝিকুরিয়া প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা। বিক্ষোভের জেরে দু’টি খাদান বন্ধ হলেও এলাকায় নতুন করে দু’টি বেআইনি খাদান তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রশাসন অভিযানের কথা বললেও বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালি ব্যবসায়ীদের জানিয়েই তল্লাশি হয়। ফলে, অভিযানে আর অনিয়ম ধরা পড়ে না।

ঝাড়গ্রাম জেলাতেও একই ছবি। চুবকা অঞ্চলে কংসাবতীর পাড়ের একাধিক জায়গায় চলছে বেআইনি বালি খাদান। বালি বোঝাই কয়েকশো লরি দিনরাত যাতায়াত করছে। রাস্তা ভাঙছে। ঝাড়গ্রাম ও খড়্গপুরের মধ্যে সংযোগকারী তারাপুর খালের সেতুটির একাংশ ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু বিপজ্জনক দুর্বল সেতু দিয়েই চলছে বালি বাহী অজস্র লরির যাতায়াত। স্থানীয় বাসিন্দা ডগমণি হাঁসদা, বিশ্বনাথ টুডু, রসিক মাহাতোদের কথায়, “এলাকায় বালি ব্যবসায়ীদের প্রভাব এত বেশি যে মানুষের প্রাণ গেলেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই।’’ ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির নেতা অসিত খাটুয়াও এ ব্যাপারে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে দরবার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এতে একে সরকারের রাজস্বের ক্ষতি, অন্য দিকে গ্রামগুলো বিপন্ন হয়ে পড়ছে।’’

যদিও ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা জেলার ভারপ্রাপ্ত ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক টি সুব্রক্ষ্যণম বলেন, ‘‘জেলায় কোনও অবৈধ খাদান নেই। তবু নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযানও চলছে।’’

ভারতী ঘোষ যখন জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন, সেই সময় বালি ব্যবসায় পুলিশি জুলুমের অভিযোগে আবার বিক্ষোভও হয়েছে। এক সময় মেদিনীপুর সদরের কনকাবতীতে পথ অবরোধ করেছিলেন বালি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত খাদান মালিক, লরি মালিক, লরি চালকেরা। অবরোধকারীদের বক্তব্য ছিল, পুলিশ রাস্তার মাঝে গাড়ি চালকদের হেনস্থা করে। দু’শো টাকার মতো রসিদ দেয়। আর বাইশ হাজার টাকা চায়। ক্যারিং অর্ডার (সিও) থাকে। তাও পুলিশ অন্যায় ভাবে হেনস্থা করে। দাবি মতো টাকা না দিলে পুলিশ কেস দিয়ে দেয়।

ভারতী-পর্ব এখন অতীত। তবে ছবিটা বদলায়নি। (তথ্য: কিংশুক গুপ্ত, অভিজিৎ চক্রবর্তী, বরুণ দে ও দেবমাল্য বাগচী) শেষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন