নিজের দোকানের সামনে রামচন্দ্র কামিলা। নিজস্ব চিত্র
নিজের পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মধ্য বয়স্ক রামচন্দ্র কামিলা। কথা বলছিলেন এক দিনের ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে। ওই দিন হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছিল কাঁথি-১ ব্লকের হিরাকনিয়া গ্রাম। কারণ, নিষিদ্ধ আতসবাজি বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছিল রামচন্দ্রের বাড়িতে।
সেদিনের ওই ঘটনায় পুড়ে গিয়েছিল রামচন্দ্রের বাড়ি। আর তিনি হারিয়েছিলেন নিজের স্ত্রী আরতী, মেয়ে চম্পা, ভাইয়ের স্ত্রী পূর্ণিমা এবং মাত্র আট মাসের নাতনিকে। ওই ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে চার চারটে বছর। বেআইনি আতসবাজি বানানো যে কতটা ভয়াবহ, স্বজন হারিয়ে সে কথা বুঝেছিলেন রামচন্দ্রবাবু। তাই এখন পান-বিড়ির দোকান চালান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ওই দিনের কথা মনে করতে চাই না। এক মুহূর্তে জীবনটা উলটপালট হয়ে গিয়েছিল।’’
এক সময় কাঁথির-১ ব্লকের যে হিরাকনিয়া গ্রাম নিষিদ্ধ আতসবাজির আড়ত ছিল, রামচন্দ্রের বাড়ির দুর্ঘটনা দেখে সেখানে এখন পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয়েরা জানিয়েছেন, এই গ্রামে আর আগের মতো আতসবাজি বানানো হয় না। কিন্তু পাশের গ্রাম সিলামপুরে এখনও রমরমিয়ে নিষিদ্ধ আতসবাজি বানানো চলছে বলে অভিযোগ। ওই গ্রামের প্রধান পাড়ায় যে এখনও বাড়িতে বাড়িতে বাজি তৈরি হয়, উৎসবের মরসুমে সে কথা বাজির ক্রেতারা ভালই জানেন।
বাজির ক্রেতা হিসাবেই যাওয়া হয়েছিল ওই গ্রামের প্রধান পাড়ায়। গিয়ে দেখা গিয়েছে, বাতাসে বাজির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা বারুদের গন্ধ স্পষ্ট। তবে কোন বাড়িতে তৈরি হচ্ছে বাজি, তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। যে সব পরিবারে বাজি তৈরি হয়, তাদের বাড়ি বাইরে থেকে বন্ধ থাকে। বাজি কিনতে চাই বলে খোঁজ করলেও চেনা মুখ না হলে সহজে কেউ বাজির বিক্রির প্রসঙ্গ তোলেন না। আর পুলিশ বা সংবাদমাধ্যমের লোক এসেছে, তা একটু আঁচ পেলেই বাড়ির পুরুষেরা গা ঢাকা দেয়। তখন বাড়ির মহিলারা বেরিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
নাম প্ৰকাশে অনিচ্ছুক সিলামপুরের এক বাসিন্দা বলেন, “এখানে বাজি বানানো হয়, তবে খুচরো বিক্রি হয় না। পাইকারি ব্যবসায়ী ধরা রয়েছে। কেবল তাঁরা এলেই বাজি প্রস্তুতকারীরা তাঁদের বাজি বিক্রি করেন।’’
হিরাকনিয়া কামিলা পরিবারের ঘটনা থেকে সিলামপুর শিক্ষা নেয়নি কেন? প্রধান পাড়ায় পাকা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, “এই গ্রামে এখন অনেকের বাগদা ও ভ্যানামেই চিংড়ি ফার্ম রয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না। তখন বেশি লাভের আশায় অনেকে বাজি বানাত। সেই সেই রেওয়াজ এখনও তাঁরা ছাড়তে পারেননি। দেখছেন না, বাতাসে কেমন বারুদের গন্ধ রয়েছে।’’
নিষিদ্ধ বাজি বানানো নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য দীপক অধিকারী বলেন, “আগে অনেক পরিবার বাজি বানাত। আমরা সবাইকে সচেতন করেছি। এখন হিরাকনিয়া গ্রামে কেউ বানায় না। তবে সিলামপুরে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার বাজি বানায়। অনেকবার অভিযান করেছি। এবার এলাকার লোকেদের নিয়ে, তা পুরোপুরি বন্ধের প্রয়াস নেওয়া হবে।’’
জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইন্দ্রজিৎ বসু বলেন, “আমরা যখন তখন এই সব এলাকায় অভিযান চালাই। উৎসবের মরসুম শুরু হল। এ বার লাগাতার অভিযান চালাব। কিন্তু পুলিশ আসার খবর পেলে এলাকার লোকেরা বাড়ি ছেড়ে পালান।’’
(শেষ)