Society

কালোর এমন আলো আগে টের পাইনি

এখন মধ্য যৌবনে এসেও শুনতে হয়, কালো মেয়ে বলেই আমার নাকি কপাল পোড়া। কিন্তু মোটেই না। আমি তো লড়াই করে চলেছি। লড়াইয়ের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি জীবনের আলো।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৯
Share:

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

সেই কোন ছোটবেলার কথা। পুজোর জামা কেনা হবে। সেই প্রথম শুনেছিলাম, আমি কালো। তাই আমাকে নাকি গাঢ় রংয়ের পোশাকে মানাবে না। আরও কালো লাগবে। আমার জন্য বরাদ্দ হালকা রং। বাবা-মা কখনও এমন বলেননি। তবে আত্মীয়স্বজন ও পড়শিদের একাংশের কাছে এমন শুনেই আমার শিশু থেকে কিশোরী হয়ে ওঠা।

Advertisement

এখন মধ্য যৌবনে এসেও শুনতে হয়, কালো মেয়ে বলেই আমার নাকি কপাল পোড়া। কিন্তু মোটেই না। আমি তো লড়াই করে চলেছি। লড়াইয়ের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি জীবনের আলো। বেঁচে থাকার রসদ। আমার আট বছরের ছেলে অঙ্কুশের জন্যই তো আমাকে বাঁচতে হবে। নিজের জন্যও বাঁচতে হবে। এখন দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ ঘন্টাই আমার কর্মব্যস্ত জীবন। স্কুলের অতিথি শিক্ষিকা, নিজের নাচের স্কুল আর ভালবেসে মঞ্চের নাটকে অভিনয়— সময় যে কোত্থেকে চলে যায়।

আমার জন্ম ঝাড়গ্রাম শহরে। বাবা সমাজসেবা করে জীবনের সত্তরটা বছর পার করে এখন ক্লান্ত, অবসন্ন। মা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকা ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। আমি ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। নাচেও ডিপ্লোমা করেছি। ঝাড়গ্রাম শহরে নাচের স্কুল চালাই। এ ছাড়াও রানি বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষিকা হিসেবে ওই স্কুলের ছাত্রীদেরও নাচের তালিম দিই। আর সময় সুযোগ পেলেই নাটকে অভিনয় করি। এটা আমার প্যাশন।

Advertisement

গায়ের রং কালো বলে ছোট বেলা থেকেই গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ে টিকল না। আমি তখন ছিলাম রোগা-পাতলা। তার উপর গায়ের রং কালো। আড়ালে শ্মশানকালী বলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসিও হত। গুমরে গুমরে কাঁদতাম। ভালবাসার মানুষটাও হয়তো বুঝল কালো মেয়ে ভাল নয়। সে ঠকেছে। তাই একদিন দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ফিরে এলাম বাবা-মায়ের কাছে। সাড়ে ছ’বছর ধরে বাবা-মায়ের কাছে আছি। অতিথি শিক্ষিকা হিসেবে ও নাচের স্কুল চালিয়ে যেটুকু উপার্জন করছি তাতেই নিজের আর ছেলের খরচ চালাচ্ছি। কলকাতায় রবীন্দ্রসদন, শরৎ সদনের মত বহু মঞ্চে নাচের অনুষ্ঠান করার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া ভিন্‌ রাজ্যেও নাচের অনুষ্ঠান করেছি। সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ডাক পাই।

এখন নিজের পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছি। কারও স্ত্রী হিসেবে নয়। ঝাড়গ্রামের অনেক মানুষই কোয়েল হিসেবে আমাকে চেনেন। এটাই আমার প্রাপ্তি। ঘর ভাঙার পরে আমার দুর্যোগ যাত্রার পথে পাশে কিছু ভাল মানুষজনকেও পেয়েছি। যাঁরা এখনও পর্যন্ত আমাকে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন। তবে এই তো কিছুদিন আগে এক প্রবীণ নৃত্যশিল্পী বললেল, ‘‘কালো মেয়ে যতই ভাল নাচুক, একদমই মানায় না।’’ শুনে খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এই সমালোচনাও আমার এগিয়ে যাওয়া বলে মনে হয়েছিল। তারপরই ঘটনাচক্রে যোগাযোগ হল কলকাতার বিশিষ্ট প্রোফেশন্যাল ফোটোগ্রাফার দেবাশিস কুণ্ডুর সঙ্গে। গায়ের কালো রংয়ের জন্য আমাকে বিষয় (সাবজেক্ট) হিসেবে বেছে নিলেন দেবাশিসদা। বহু জায়গায় উনি আমার ফোটোশ্যুট করেছেন। বিশিষ্টজনের সান্নিধ্যে এসে বুঝলাম, কালোর মধ্যেও আবেদন রয়েছে। ঝাড়গ্রামের মিন্টুদার (অরিন্দম দত্ত) মাধ্যমে যোগাযোগ হল পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য উনি ‘রক্তপলাশ’ ওয়েব সিরিজের একটি চরিত্রে আমাকে মনোনীত করলেন। কালো মেয়ের ভূমিকায়। পরে ওই ওয়েব সিরিজে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়েছি। কালোর এমন আলো সেটা তো আগে কখনও বুঝিনি।

কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচনের কথা লিখেছেন সাধক রামপ্রসাদ। এক সময় মনে হয়েছিল, সে তো কথার কথা। কিন্তু বাস্তবে এখনও এই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে কালোদের কদর নেই। মা কালীও তো কালো। তাহলে তাঁকে যদি দেবীরূপে পুজো করা হয়। তাহলে আমার মত কালো মেয়েরা কেন এখনও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে গুমরে কেঁদে মরবে?

এখন সমাজ আমাকে কালো বলুক। বলতেই থাকুক। আমি অন্ধকারের মধ্যে আলোর সন্ধান পেয়েছি। বুঝেছি আমি কালো, সেই তো আমার ভাল!

(অনুলিখন: কিংশুক গুপ্ত, কুণাল বর্মন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন