প্রতীকী ছবি।
দু’বছর আগেও কাজ ছিল, মেয়ের স্কুল ছিল, বৌয়ের চিকিৎসা চলছিল। সবই ছিল মু্ম্বইয়ে। তখন আমি স্বর্ণশিল্পী। গয়নায় সূক্ষ্ম সব ডিজ়াইন তুলতে ব্যস্ত। সেই আমিই এখন গ্যারাজে মোবিল ফেরি করি।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে আমাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। ছোট থেকে শুনেছি ২৬ জানুয়ারি দিনটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে পড়াকালীন মাস্টারমশাইরা বলতেন, এই দিন দেশ পেয়েছিল সংবিধান। আর সেই সংবিধান নাকি দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারের রক্ষাকবচ।
সত্যি কি তাই! তাহলে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের অধিকার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের অধিকার কেন পাব না আমরা!
করোনা-কালে তো এই প্রশ্নগুলো আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধছে। ২০২০ সালে প্রথম লকডাউনেই বাড়ি ফিরেছিলাম। মুস্বইয়ের সোনার দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সম্বল বলতে এক মাসের বেতন। হাতে বাড়তি টাকাও ছিল না। তারসঙ্গে জুড়েছিল বাড়ি ফেরার উদ্বেগ। পাক্কা ৪০ দিন অপেক্ষা করে স্পেশাল ট্রেনে উঠেছিলাম। দাসপুরে পৌঁছে স্থানীয় স্কুলে ১৫দিন থাকতে হয়েছিল। স্ত্রী আর মেয়ে বাড়ি ফিরেছিস তার কয়েক মাস আগেই।
দাসপুরের সোনামুই গ্রামে আমার বাড়ি। স্ত্রী, মেয়ে ছাড়াও বৃদ্ধ বাবা মা রয়েছেন। বছর কুড়ি-বাইশ ধরে সোনার কাজ করেছি। মু্ম্বইয়ে থাকতাম। স্ত্রী, মেয়েও আমার সঙ্গেই থাকত। মুম্বইয়ের স্কুলেই মেয়েকে ভর্তি করেছিলাম। তবে ক্লাস থ্রি-র পরে আর তো ওখানে পড়তে পারল এখানে ফিরে মেয়েকে সোনামুইয়ের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু কাজ হারানোয় খরচ টানতে পারলাম না। ওই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ওকে এখন গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেছি। একে ওর কাছে সব নতুন। তার উপর অনলাইনে পড়াশোনা হওয়া-না হওয়া তো সমান। না। স্ত্রীর রক্তাল্পতার চিকিৎসাও মুম্বইয়ে করাচ্ছিলাম। করোনা আর লকডাউনে সব ওলটপালট হয়ে গেল। দু’বচ্ছর হল স্ত্রীর সব রকম চিকিৎসা স্থানীয় ভাবেই করাতে হচ্ছে।
আমি সোনার সব ধরনের কাজই করতাম। ভাল রোজগার ছিল। মুম্বইয়ের সংসার সামলে বাড়িতে বাবা-মাকে টাকা পাঠাতাম। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে আমার বহু বন্ধু পুরনো কাজের জায়গায় ফিরেছে। আমিও মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু পুরনো দোকান থেকে আর ডাক পাইনি। শুনেছিলাম দাসপুরে সোনার হাব হচ্ছে। এতদিনে তা হলে ভাল হত। সে কাজ এত বচ্ছর ধরে শিখেছি, যে কাদে ভাল লাগা ছিল, রোজগার ছিল, দু’বছর ধরে লড়াই করেও সেই সোনার কাজ জুটছে না। যে হাতে নিত্য নতুন গয়নার নকশা তুলতাম, সেই হাতে এখন মোবিল বিক্রি করি। ছোটবেলায় শোনা সংবিধানের দেওয়া অধিকারের কথা এখন সোনার পাথর বাটি মনে হয়।