লাভ দ্বিগুণ, দিব্যি চলে চোলাই

ময়না, আড়ংকিয়ারানা, দুধকোমড়া, খেজুরি— জায়গার নামগুলো শুধু বদলে যায়। বদলায় না পরিস্থিতি। শত চেষ্টাতেও কমানো যাচ্ছে না চোলাই বিক্রির বহর।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ঘাটাল শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০০:২৯
Share:

এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তৈরি হয় চোলাই। ছবি: কৌশিক সাঁতরা।

ময়না, আড়ংকিয়ারানা, দুধকোমড়া, খেজুরি— জায়গার নামগুলো শুধু বদলে যায়। বদলায় না পরিস্থিতি। শত চেষ্টাতেও কমানো যাচ্ছে না চোলাই বিক্রির বহর।

Advertisement

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সচেতনতার অভাব, আবগারি দফতরের উদাসীনতা ও শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের ইন্ধন-এই ত্র্যহস্পর্শেই বাড়ছে চোলাই মদের ঠেক। সস্তায় ভরপুর নেশার টানের ঠেকে বাড়ে ভিড়। সরকারের ঘরে রাজস্ব আসে না, অথচ ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। নজরদারির জন্য রয়েছে গোটা একটা দফতর। কিন্তু তাতে উপকারটা হয় কোথায়, প্রশ্ন তোলেন গ্রামের মহিলারা। আবগারি দফতরের এক পদস্থ কর্তাও কার্যত সে কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তাঁর সাফ কথা, “আমাদের দফতরে কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। এলাকায় চোলাই ব্যবসা বন্ধ না-হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের কড়া শাস্তি চালু করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনও বন্ধ হওয়া জরুরি।”

বেআইনি মদ ব্যবসায়ীরাই জানিয়েছেন, যতই ধরপাক়ড় চলুক, এ ব্যবসায় লাভ প্রচুর। দিন কয়েকের হুজ্জুত সামলে নিলেই কেল্লা ফতে। তার জন্য হাতে রাখতে হয়, পুলিশ-প্রশাসন, আবগারি কর্তা থেকে ছোট-বড় নানা মাপের রাজনৈতিক দাদাদের। তার জন্য প্রায় দ্বিগুণ লাভের ব্যবসা থেকে সামান্য টাকা খসে যায়। জেলার একাধিক ব্যবসায়ীর কথায় সেই সত্যিটাই উঠে এল, “প্রতি লিটার চোলাই তৈরিতে খরচ হয় ২০-২৫ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ৪০-৪৫ টাকায়। খুচরো বিক্রেতারা ওই মদ বিক্রি করেন লিটার পিছু ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। তার থেকে কিছু টাকা পুলিশ, আবগারি ও স্থানীয় শাসক নেতাদের পকেটে গুঁজে দিলেই তো সাত খুন মাফ!”

Advertisement

গোটা রাজ্যে চোলাই খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বা মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। বড় কোনও ঘটনা ঘটলেই চলে আবগারি দফতর ও পুলিশের তল্লাশি, ধরপাকড়। কিন্তু সে সব সামান্য থিতিয়ে গেলেই ফের শুরু হয় ব্যবসার রমরমা। প্রকাশ্যেই মদ চোলাই হয়। আবগারি দফতর ও চোলাই কারবারিরা জানিয়েছেন, ক্রমশ চোলাই বাড়ছে বিষের পরিমাণ। বাড়ছে মৃত্যুর আশঙ্কাও। মদের নেশা দ্বিগুণ করতে চোলাইয়ে মেশানো হচ্ছে কীটনাশক, মিথানল, ইউরিয়া। এতে নেশাড়ুদের আকর্ষণ বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ। অল্প বয়সেই কেউ হারাচ্ছেন চোখ, কেউ বা কিডনি ও ‌লিভারের সমস্যায় ভুগছেন।

সামাজেও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। মূলত নিম্নবিত্ত, হত দরিদ্র পরিবারের মানুষগুলি জড়ো হন পাড়ার চোলাই ঠেকে। বয়েস সেখানে কোনও বিষয় নয়। দিন মজুরি করা কিশোর থেকে বৃদ্ধ চাষি বাদ যান না কেউ। তারপর পরিবারের উপর চেল অত্যাচার। তেমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে দাসপুর। চলতি বছরের গোড়ায় মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে খুন করেছিলেন এক মহিলা। তারপরই স্থানীয় দুধকোমড়া, কাশিয়াড়া-সহ সংলগ্ন গ্রাম গুলিতে চোলাইয়ের ঠেক ভেঙে দিয়েছিলেন মহিলারা।

দুধকোমরায় প্রকাশ্যে চোলাই বিক্রির প্রবণতা তারপর অনেকটা কমলেও, বিক্রি বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। ঘাটাল, দাসপুর থেকে চন্দ্রকোনা-সহ জেলার প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ গ্রামেই রমরম করে চলছে চোলাই ব্যবসা। অথচ, ওই ঘটনার পরই দফতরের ডেপুটি কালেক্টর অশোক দে দাবি করেছিলেন, “এ বার ধারাবাহিক অভিযান চলবে। পুরোপুরি চোলাই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে।” কিন্তু মাস সাতেক হতে চলল এখনও বন্ধ হয়নি ওই কারবার। উল্টে বাড়ছে।

অশোকবাবু অসহায়, “মানুষকে সচেতন হতে হবে। তাই এ বার আমরা শিবির করার কথা ভাবছি।” ঘাটালের মহকুমাশাসক পিনাকীরঞ্জন প্রধানও বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন পঞ্চায়েতেই শিবির থেকে লিফলেট বিলি করা হবে। চোলাই মদ তৈরি হলেই এলাকার মানুষ যাতে ফোন করে জানাতে পারেন সে জন্য হেল্প ডেস্কও চালু করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন