Rape vicitm

 ঘুরে দাঁড়াতে ধর্ষিতা, সন্তানেরও চাই সাবালক সমাজব্যবস্থা

পরিবারের বা পাড়ার বা গ্রামের ‘সম্মানরক্ষায়’ ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতেও বাধ্য করে। বিচার পাওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার-পাচার-বারবার ধর্ষণের আবর্তে তলিয়ে যায় সেই সব কিশোরীরা।

Advertisement

শাশ্বতী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৪
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

Advertisement

বেণী দুলিয়ে কলকল করে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ইস্কুলে যাওয়া-আসার পরিবর্তে দ্বাদশী কিশোরী আজ ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতের রায়ে গর্ভপাত করাতে যায়! কিন্তু তার শরীরের অবস্থা আর গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা বিচার করে শেষ পর্যন্ত গর্ভপাত করানো গেল না, জন্ম হল এক কন্যাসন্তানের।

মেয়েটি গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ধর্ষকেরাও নাবালক। কিন্তু অপরাধীর তকমা তো পড়ে গেল তাদের গায়ে। বালিকার পরিবার তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে বললেও তার সন্তানকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তাকে হয়তো তুলে দেওয়া হবে কোনও হোমের কাছে। অর্থাৎ, এক সঙ্গে একাধিক জীবন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, অনভিপ্রেত এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

Advertisement

যখন এই কিশোরী শরীরে-মনে গভীর ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরে নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টা করবে, তার পাশে কে থাকবে ওই ক্ষত মুছিয়ে নতুন জীবনে ফেরার পথ করে দেওয়ার জন্য?

যে আর্থ-সামাজিক স্তরে তার অবস্থান সেখানে এখনও আমাদের দেশে খুব অল্প মানুষেরই এই অত্যাচারিত মেয়েদের অতীত ভুলিয়ে সুস্থ ভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা রয়েছে। সাবালক সমাজব্যবস্থার একটা ঔদার্য্য থাকে। সেখানে যেমন ব্যক্তিস্বাধীনতা মর্যাদা পায়, নিন্দিত হয় অপরাধী।

আর অপরিণত সমাজ তার উল্টো। সেখানে অত্যাচারিত চলে আসবে নিন্দা-বিদ্রূপ-কটাক্ষের কেন্দ্রে। আত্মীয়-চেনাপরিচিত প্রায় প্রত্যেকে কারণ-অকারণে মনে করিয়ে দেবে তার যন্ত্রণার অতীত। মুখরোচক খোশগল্পের বিষয়বস্তু হবে তার যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত। তার নতুন করে বাঁচার পথে বার-বার দেওয়াল তোলা হবে। ভেঙে দেওয়া হবে তার আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান। শুধু তাই নয়, ধর্ষিতার সন্তানের কাছেও পথচলার প্রতিটি বাঁক হবে বড় কঠিন, সঙ্কটময়।

তবু তো এই কিশোরীর কথা সামনে এসেছে। সে পাশে পেয়েছে তার পরিবারকে। কিন্তু এ রকম বহু কিশোরী প্রায় প্রতিদিন গা-গঞ্জ-শহরে একই রকম অত্যাচারের শিকার হয়ে মুখ লুকিয়ে হারিয়ে যায়। তাঁদের পরিবার ঘটনা গোপন করে হয়তো অন্য কোথাও তাকে সরিয়ে দেয় বা বিয়ে দিয়ে দেয়, বা তাকে পরিত্যাগ করে।

এমনকি পরিবারের বা পাড়ার বা গ্রামের ‘সম্মানরক্ষায়’ ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতেও বাধ্য করে। বিচার পাওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার-পাচার-বারবার ধর্ষণের আবর্তে তলিয়ে যায় সেই সব কিশোরীরা।

অনেক কিশোরী আবার শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধির কৌতূহলে শরীর নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে মা হয়ে যায়। আবার সেই কৌতূহল, যৌনতা সম্পর্কে বিকৃত ধারণা থেকে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে ফেলে কিছু নাবালক। যার দাম তাদের সারাজীবন ধরে দিয়ে যেতে হবে। অথচ, এমন তো হওয়ার কথা নয়। বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীদের জন্যই ‘অন্বেষা ক্লিনিক’ খোলা হয়েছিল, যেখানে যাতে নিজের শরীর নিয়ে ঠিক কথাগুলো তারা জানতে পারে। কিন্তু তাতে কতটা কাজ হল? যে কিশোরীরা যৌন নিগ্রহের শিকার, তাদের পাশে থাকার জন্য আমরা কী ব্যবস্থা করতে পারছি?

অভিযোগ তুলে নেওয়ার চাপ, অভিযোগ নিয়ে টালবাহানা, পুলিশি হেনস্থা, আদালতে দিনের পর দিন হাজিরা, আত্মীয়-পরিজনের উদগ্র কৌতূহল, অতিরিক্ত সহানুভূতি তাকে বিধ্বস্ত করে। সেই সঙ্গে আবছা হতে থাকে ভবিষ্যতের পথ।

এই সময় বরং পরিবার,পরিজন, পাড়াপড়শি, ইস্কুল – সবার থেকে পাশে থাকার বার্তা আসা দরকার যে, ‘দোষী তুমি নও। দোষী তোমার নিগ্রহকারীরাই।’ তবেই কিন্তু এই মেয়েদের জীবন আবার নতুন খাতে বইতে পারবে। এই মোবাইলশাসনের যুগে, শরীর ভার্চুয়াল মাধ্যমে সহজলভ্য হয়ে কিশোর-কিশোরীদের আকাঙ্খা, ভ্রান্ত যৌন আগ্রহ বাড়ছে, নিগ্রহ বাড়ছে, কিন্তু সতর্কতা বাড়ছে না। জীবন দিয়ে সেই শিক্ষা পেতে বাধ্য হচ্ছে কিশোরীরাই, আর অপরাধের কালি মেখে কিশোররাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন