বারবার প্রার্থী বদলই তমলুকে তৃণমূলের ‘ট্র্যাডিশন’। কখনও তাতে জয় এসেছে, কখনও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। এ বারও সেই বদলি প্রার্থীরই কেন্দ্র পূর্ব মেদিনীপুরের সদর শহর।
২০০১ সালে তমলুক থেকে তৃণমূল-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বেদ রায়। কিন্তু ২০০৬ সালে আর সেখানে টিকিট পাননি বিদায়ী বিধায়ক। প্রার্থী বদল করে তমলুকে সে বার হার হয়েছিল তৃণমূলের। ২০১১ সালে ফের প্রার্থী বদল। নতুন প্রার্থী সৌমেন মহাপাত্র জিতে প্রথম তৃণমূল সরকারের জলসম্পদ মন্ত্রীও হয়েছিলেন। এ বার সেই সৌমেনবাবুকেই তমলুক বিধানসভা থেকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা বিধানসভা কেন্দ্রে। আর দীর্ঘ ১০ বছর পর ফের তমলুকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন নির্বেদ রায়।
তবে তৃণমূলের এ বার লড়াই শুধু বামফ্রন্টের সঙ্গে নয়। কারণ গতবার তৃনমূলের জোটসঙ্গী কংগ্রেস এ বার বামেদের জোটসঙ্গী। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও বদল হয়েছে।
২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে জমিরক্ষা আন্দোলনের জেরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূলের রাজনৈতিক উত্থান হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দল থেকে শাসকদল হিসেবে তৃণমূল সরকারের গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। সারদা কাণ্ড থেকে নারদ কাণ্ড এবং সর্বশেষ কলকাতায় উড়ালপুল ভেঙে মৃত্যুর ঘটনায় শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধী বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, বিজেপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ফলে এ বার বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দল তৃণমূলের লড়াই কঠিন হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের অভিমত।
গত ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ২০ হাজার ভোটে জিতেছিল তৃণমূল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ব্যবধান বেড়ে হয় ৩০ হাজারের সামান্য বেশি। কিন্তু এ বার বিধানসভা নির্বাচনে তমলুক কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী নির্বেদ রায়ের সঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিআই প্রার্থী অশোক দিন্দার লড়াই জমে উঠেছে।
জেলার রাজনৈতিক মহলের মতে, তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরেই স্থানীয় নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দল বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে দলের সেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে থাকে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অধিকারী পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বিরোধী গোষ্ঠীর বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হয়।আর তমলুকে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল এতটাই চরমে ওঠে যে তমলুকের বিধায়ক তথা রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তমলুক শহরে প্রকাশ্যে মিছিল করে অধিকারী শিবিরের ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লক সভাপতি দিবাকর জানা-সহ দলের কয়েকশো সমর্থক। এ বার বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণার দিনেই শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে মন্ত্রী সৌমেনবাবুর শিবিরের ঘনিষ্ঠ চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করে তৃণমূলের সদস্যারাই। ঘটনায় ফের তৃণমূলের কোন্দল প্রকাশ্যে আসে।
আর মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রকে এ বার তমলুক কেন্দ্রে থেকে সরিয়ে গতবার হেরে যাওয়া পিংলা বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করার জন্য তাঁর অনুগামীরা ক্ষুদ্ধ। ফলে এ বার বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোট বেঁধে লড়াই করার মুখে পড়া তৃণমূল প্রার্থী নির্বেদ রায়ের পথের কাঁটা নিজের দলের তীব্র গোষ্ঠী কোন্দল, মনে করছে দলের একাংশ।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৪ মার্চ তমলুক বিধানসভার প্রার্থী হিসেবে নির্বেদবাবুর নাম ঘোষণার একমাস পরেও সেই শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে তৃণমূলের দুই শিবিরের বিভাজন ঘোচেনি। শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে নির্বেদবাবুর সঙ্গে প্রচারে জোর কদমে নেমেছে অধিকারী শিবিরের ঘনিষ্ঠরা। আর তাঁদের এড়িয়ে সৌমেনবাবুর অনুগামীরা আলাদাভাবেই নির্বেদ রায়ের হয়ে প্রচার চালাচ্ছ । ফলে তৃণমূলের দুই শিবিরের ঠান্ডা লড়াই অব্যাহত নির্বাচনের প্রচারেও, যা এলাকার বাসিন্দাদের কাছে স্পষ্ট।
সোমবার পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শাসকের অফিসে গিয়ে নির্বেদবাবু তাঁর প্রার্থীপদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে তার আগে থেকেই তমলুক শহর ও গ্রামীণ এলাকায় প্রচারও চালাচ্ছেন।
সোমবার পশ্চিম মেদিনীপুরে নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হয়ে গিয়েছে। এবার কি তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রে প্রচারে আসবে? মঙ্গলবার সৌমেনবাবু বলেন, ‘‘দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী আমি বর্ধমানে প্রচারে চলে যাব। আগামী ২৪ এপ্রিল সেখানে ভোট। আর নির্বেদবাবু চাইলে বা দলনেত্রী নির্দেশ দিলে আমি তমলুকে প্রচার করতে যাব।’’
তৃণমূলের এই শিবির বিভাজনের ফলে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই বেশ জোরদার হবে বলে বাম শিবিরের আশা। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটের সিপিআই প্রার্থী অশোক দিন্দা প্রবীণ রাজনীতিক হলেও এবার প্রথমবার বিধানসভা ভোটে
লড়াই করছেন।
অশোকবাবুর মতে, ‘‘তৃণমূল সরকারের আমলে রাজ্যে শিল্পায়নের গতি বন্ধ হয়েছে। তার উপর নানা দুর্নীতির সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের জড়িয়ে পড়ায় মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। আর এখানে তৃণমূলের নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দলও মানুষ দেখছে। মানুষ তৃণমূল সরকারকে সরাতে চাইছে বলেই জোট হয়েছে। তাই আমরা জেতার বিষয়ে আশাবাদী।’’