তৃণমূলের বৈঠক সেই ‘সুভাষের’ বাড়িতেই

প্রকাশ্য সভায় যে ঠিকাদাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই সুভাষ দাসের অতিথিশালায় বৃহস্পতিবার তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলা কমিটির বৈঠক হল।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:৩৮
Share:

সুভাষ দাসের অতিথিশালা থেকে বৈঠক সেরে বেরিয়ে আসছেন তৃণমূল নেতারা। বাঁ দিকে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঝে চূড়ামণি মাহাতো। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুভাষ (ডানদিকে)। নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ্য সভায় যে ঠিকাদাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই সুভাষ দাসের অতিথিশালায় বৃহস্পতিবার তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলা কমিটির বৈঠক হল।

Advertisement

এ দিন দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তথা অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতো, রাজ্যের তরফে ঝাড়গ্রামের দলীয় পর্যবেক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সাংগঠনিক জেলার গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চাশ জন নেতা-নেত্রীরা হাজির ছিলেন। বৈঠক চলাকালীন চা, নোনতা বিস্কুট থেকে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও ছিল। বৈঠকের যাবতীয় আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন ঠিকাদার সুভাষবাবু।

ঝাড়গ্রাম শহরের ঘোড়াধরা এলাকায় সুভাষবাবুর বাড়ি। ওই বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে বিলাসবহুল ঝাঁ চকচকে ‘অনন্যা’ অতিথিশালা। ওই অতিথিশালার দোতলায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম, সুইমিং পুল-সহ এলাহি আয়োজন।

Advertisement

গত বছর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল কমিটি ভেঙে ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলা কমিটি ভাগ করে দেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চূড়ামণি মাহাতোকে দলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কার্যকরী সভাপতি হন দুর্গেশ মল্লদেব। দলের রাজ্য কমিটির তরফে দলের শ্রমিক শাখার সর্বভারতীয় নেতা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর বছর গড়িয়ে গেলেও এতদিন পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠিত হয়নি। আগামী বছরের এপ্রিলে ঝাড়গ্রাম পৃথক জেলা হচ্ছে। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের আগে জঙ্গলমহলে দলের সংগঠন গোছাতে তৎপর শাসকদল। ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলার ৮টি ব্লকের নেতা-নেত্রীদের পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটিতে রাখা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা নাগাদ একে একে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা সুভাষবাবুর অতিথিশালায় এসে পৌঁছন। সুভাষবাবুর বাড়ি থেকে কাপের পর কাপ চা পাঠানো হয় বৈঠকে। শহরের একটি ক্যাটারিং সংস্থাকে দিয়ে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন সুভাষবাবু। মেনুতে ছিল সাদা ভাত, ঝুরি আলু ভাজা, মুগের ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, মাছের ঝোল আর আমসত্ত্বের চাটনি। নেতা-মন্ত্রীদের আপ্ত সহায়ক ও নিরাপত্তা রক্ষীদেরও পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়।

ঝাড়গ্রাম জেলা ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে দীর্ঘদিন যাবত রোগীদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে সুভাষবাবুর সংস্থা এসবি এন্টারপ্রাইজ। এ ছাড়া হাসপাতালের গাড়ি, জেনারেটর-সহ আরও বেশ কিছু জিনিসপত্র সরবরাহ করেন সুভাষবাবু। অভিযোগ, হাসপাতালে কার্যত সুভাষবাবুর একচ্ছত্র রাজত্ব চলে। রোগীদের খাবার দাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার অভিযোগ তোলা হয়েছে। বাম আমলে এবং বর্তমান সরকারের আমলে বহুবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুভাষবাবুকে সতর্ক করেছেন। তাঁর সংস্থাকে শো-কজও করা হয়েছে। কিন্তু
ওই পর্যন্তই।

তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ঝাড়গ্রাম শহর তৃণমূলের একাংশের সঙ্গে সুভাষবাবুর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত তিন বছরে সুভাষবাবুর সংস্থার বিরুদ্ধে হাসপাতালে সরবরাহ করা খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ তোলা হলেও কোনও তদন্ত হয়নি। গত ৩ নভেম্বর জামবনিতে এক সরকারি জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, যাঁরা হাসপাতালে সমস্যা তৈরি করছেন, তাঁদের রেয়াত করা হবে না। ওই দিনই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব, যুগ্মসচিব ও যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (নার্সিং) ঝাড়গ্রাম জেলা ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে তদন্তে যান। সিদ্ধান্ত হয়, খাবারের মান নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য দফতরে রিপোর্ট পাঠানো হবে।

বৃহস্পতিবার দলীয় বৈঠক সেরে বিকেল চারটে নাগাদ অনন্যা অতিথিশালা থেকে সপার্ষদ বেরিয়ে আসেন ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি চূড়ামণি মাহাতো। সুভাষবাবুর অতিথিশালায় দলীয় বৈঠক করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মেজাজ হারান চূড়ামণিবাবু। তাঁর হুঙ্কার, “অভিযোগটা কে করছে শুনি।” পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে চূড়ামণিবাবুর সাফাই, “সুভাষবাবু একজন ব্যবসায়ী। তিনি কী ব্যবসাও করতে পারবেন না।” চূড়ামণিবাবুর গাড়ির পিছনের সিট থেকে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা অতিথিশালাটি ভাড়া করে বৈঠক করেছি।” মুখ্যমন্ত্রী যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, তাঁর অতিথিশালায় কেন বৈঠক হল? এবার চূড়ামণিবাবু বলেন, “এ ব্যাপারে আমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।”

সুভাষবাবু অবশ্য বিনীতভাবে জানাচ্ছেন, “আমি একজন একনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মী। দলের স্বার্থে যতটুকু করার ততটাই করেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন