জল চুরি রুখবে কে!

চাষের জমিতে জোর করে ভেড়ি করা নিয়ে গোলমালেই খুন হন ভগবানপুরের তৃণমূল নেতা নান্টু প্রধান। বছর ঘুরেছে। চাষের জমিতে ভেড়ির দাপাদাপিও চলছে সমানে। সেচের জল চুরির অভিযোগও রয়েছে ভেড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে। জেলা ঘুরে দেখল আনন্দবাজার। ধান জমির রাতারাতি চেহারা বদলের এমন প্রবণতায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে তমলুক, নন্দকুমার, কোলাঘাট, মহিষাদল, চণ্ডীপুর সহ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার প্রান্তিক চাষিদের।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০৫
Share:

খাল থেকে এ ভাবেই পাম্পে জল তুলে ভরে ফেলা হচ্ছে ভেড়ি। তমলুকে। —নিজস্ব চিত্র।

মাত্র তিন মাস আগে জমির ধান গোলায় তুলেছিলেন তমলুকের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের চাষিরা। সেই জমির বেশিরভাগই এখন ভেড়ি। দেখে বোঝা দায়, কখনও সেখানে মাথা দোলাত সবুধ ধান। এ যেন ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’-এর কাহিনীকে মনে করিয়ে দেয়। ধান জমির রাতারাতি চেহারা বদলের এমন প্রবণতায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে তমলুক, নন্দকুমার, কোলাঘাট, মহিষাদল, চণ্ডীপুর সহ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার প্রান্তিক চাষিদের।

Advertisement

অল্প আয়তনের জমিতে বছরে দুবার চাষ করে সারা বছরের ভাতের জোগাড় করতেন চাষিরা। কিন্তু একলপ্তে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ বিঘে ধান জমির মাটি তুলে চারদিক ঘিরে উঁচুবাঁধ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মাছের ভেড়ি। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় বিঘের পর বিঘে উর্বর ধান জমি উধাও। জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের বছর পয়ষট্টির চণ্ডীচরণ বেরা, বছর পঞ্চাশের সুকুমার বালা বলেন, ‘‘ধান জমি লিজ নিয়ে ভেড়ি তৈরি হচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ৫০ বিঘার বেশি চাষের জমি নিয়ে একটা ভেড়ি হয়েছিল। এ বছরই ৪০ বিঘে জমি নিয়ে আর একটা ভেড়ি হয়েছে। ভেড়ির গ্রাসে ধান চাষ প্রায় বন্ধ হতে বসেছে।’’

তাঁদের অভিযোগ, ‘‘এ বার চাষের জলই পাচ্ছি না। খাল দিয়ে আসা জলের সবটাই মাছের ভেড়িতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এ বার বোরো চাষে রোয়ার কাজ করতে পারছি না।’’

Advertisement

তমলুক ব্লকের অনন্তপুর ১ ও ২, পদুমপুর ১ ও ২, শ্রীরামপুর ১ ও ২, বিষ্ণুবাড় এবং শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের কাখর্দা, ধলহরা, রঘুনাথপুর-২, নন্দকুমার ব্লকের শীতলপুর, সাওড়াবেড়িয়া ইত্যাদি এলাকা ঘুরে ভেড়ি নিয়ে ক্ষোভের কথাই শোনা গেল এলাকার চাষিদের মুখে। এই সব এলাকায় জমির অধিকাংশেরই মালিক বড় কৃষকেরা। তাদের পরিবারের সদস্যরা ব্যবসা-চাকুরি সহ নানা পেশায় যুক্ত। ফলে চাষের উপর নির্ভরশীলতা নেই বললেই চলে। তাই বার্ষিক ‘লিজ’ চুক্তিতে মোটা টাকার বিনিময়ে জমিতে ভেড়ি তৈরির ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যে সব চাষির জমির পরিমাণ অল্প, তাঁদেরও ভেড়ির জন্য জমি দিতে চাপ, হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ওই সব চাষিকে চাষের জল পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সরকারি হিসেবেই জেলায় গত কয়েক বছরে চাষের জমির পরিমাণ দ্রুত হারে কমেছে। এর ফলে প্রান্তিক চাষিদের একটা বড় অংশের পাশাপাশি খেতমজুরদের জীবিকায় টান পড়েছে। যার জন্য ওই সব চাষিরা ভেড়ির রমরমাকেই দায়ী করেছেন।

প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। কারণ জেলার কোলাঘাট, তমলুক, নন্দকুমার ব্লকের বিভিন্ন এলাকার চাষিরা এ ব্যাপারে অভিযোগও করেছেন ব্লক ও জেলা প্রশাসনের কাছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসন-পুলিশ অভিযুক্তদের সতর্ক করেই দায় সারছে বলে অভিযোগ। যে কারণে ভেড়ির মালিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ।

জেলা সভাধিপতি দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘তমলুক, কোলাঘাট সহ কয়েকটি ব্লকে চাষের জমিতে ভেড়ি তৈরিতে আপত্তি জানিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। ব্লক ভূমি সংস্কার দফতরকে এইসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন