ভোট এলেই আতঙ্ক চেপে বসে চৌকিশাল জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বহু বাসিন্দাদের। ভোটের দিন তো ভয়ে কাঠ হয়ে ঘরবন্দি থাকেন অনেকে। মনে পড়ে যায়, ২০০৮ সালের সেই রক্তাক্ত ২২ অক্টোবরের কথা।
বছর আটেক আগের সেই দুপুরে সবুজ রঙা একটি মেডিক্যাল ভ্যান শাঁখাভাঙা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাথরচাকড়ি গ্রাম ঘুরে লবনি হয়ে বেলপাহাড়ি ফিরছিল। গাড়িতে ছিলেন বেলপাহাড়ি ব্লক স্বাস্থ্য দফতরের মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিটের চিকিৎসক ধনিরাম মাণ্ডি, স্বাস্থ্য সহায়িকা ভারতী মাঝি আর চালক প্রণয় মিশির। চৌকিশালের জঙ্গল-রাস্তায় পর পর চারটি মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায় মেডিক্যাল ভ্যানটি। তিন জনের শরীরই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ধনিরামবাবু ও প্রণয়বাবু ছিলেন বেলপাহাড়ির বাসিন্দা। ভারতীদেবীর বাড়ি পুরুলিয়ার কাশীপুর থানার ভালাগোড়া গ্রামে।
তখনও জঙ্গলমহলে লালগড়-কেন্দ্রিক মাওবাদীদের আন্দোলন দানা বাঁধেনি। তবে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বেলপাহাড়ির শিমুলপাল, পাথরচাকড়ি, শাঁখাভাঙা, লবনি, জামাইমারির মতো গ্রামগুলিতে মাওবাদীদের ভালই প্রভাব ছিল। ফলে, এই ঘটনাতেও মাওবাদীদের নামই জড়িয়েছিল। তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর এমন হামলায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। তাঁরা ভাবতেই পারেননি, প্রতি বুধবার বেলপাহাড়ি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নীলবাতি লাগানো যে গাড়িটা চিকিৎসা পরিষেবা দিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত, তার এই হাল হবে। এমন পরিণতি হবে চেনামুখগুলোর।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তবে সে দিনের সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় বাসিন্দাদের। বিশেষ করে ভোট এলে। কারণ, ওই ঘটনার কয়েক মাস পরেই জঙ্গলমহল জুড়ে মাওবাদী প্রভাবিত জনগণের কমিটির আন্দোলন শুরু হয়। বেলপাহাড়ির এই তল্লাটে তখন মাওবাদীরাই ছিল শেষ কথা। ভোট বয়কটের ফতোয়া দেওয়া হতো। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে লবনি, শাঁখাভাঙা, জামাইমারি-সহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা মাওবাদীদের ভয়ে ভোটও দিতে যাননি। আট বছর পরে এখন চৌকিশালের রাস্তাটি চওড়া করে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এখনও পথচলতি মানুষজনের কাছে রাস্তাটি ভয়াবহ দিনটির স্মৃতি উস্কে দেয়। ভয়ে এখনও গা ছমছম করে লবনি গ্রামের ভূধর মাণ্ডির, ‘‘সে দিন অনেকে বাড়ি থেকেই শুনতে পেয়েছিল বিস্ফোরণের শব্দ। এমনটা যে হতে পারে ভাবিনি আমরা।’’ আসলে কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। তাই প্রতি সপ্তাহে আসা ডাক্তারদাদা, নার্স দিদিই ছিলেন ভরসা। শাঁখাভাঙা গ্রামের চম্পা সর্দার বলেন, ‘‘ওদেরও যে এমন ভাবে মেরে ফেলা হবে তা ভাবিনি। তারপর থেকে আমরা রাস্তায় বেরোতে ভয় পেতাম। এখনও ওই রাস্তা দিয়ে গেলে সে দিনের কথাই মনে হয়।’’ সে দিন গাড়িটির চালকের আসনে ছিলেন প্রণয় মিশির। শিমূলপাল গ্রামের বাসিন্দা কমল সর্দার বলেন, ‘‘এমন ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।’’
চৌকিশালের মাইন-হামলার পরে পুলিশের তদন্তে বলা হয়, স্থানীয় কিছু বাসিন্দার সাহায্য নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক মাওবাদীরা এই ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়েছিল। তবে মামলা কিন্তু পরিণতি পায়নি। .ঘটনার পরে বেলপাহাড়ির তৎকালীন ব্লক মেডিক্যাল অফিসার হীরালাল বিশুইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রদ্রোহ, নাশকতা, খুন ও বেআইনি বিস্ফোরক মজুত রাখার ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। কিন্তু মূল অভিযুক্ত মাওবাদী স্কোয়াড নেতা মদন মাহাতো, তাঁর স্ত্রী মাওবাদী নেত্রী জবা মাহাতো, মাওবাদী নেতা আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডল ও রঞ্জিত পালরা এখনও ফেরার। ১৪ জন অভিযুক্তের মধ্যে মাওবাদী নেত্রী অনু মাইতি ও স্থানীয় গ্রামবাসী-সহ ১০ জন গ্রেফতার হন। পরে অবশ্য অশোক কর্মকার, বিশ্বনাথ সিংহ, বাগরাই সরেন, লোচন সিংহ সর্দার, মানা বস্কে, সিকান মুর্মুর মতো ৮ জন অভিযুক্ত গ্রামবাসী জামিনে ছাড়া পেয়ে যান।
পুলিশ সময় মতো আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে না পারার জন্যই অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যান বলে অভিযোগ। তবে অন্য একটি মামলায় জামিন না-মেলায় এখনও জেলে রয়েছেন অনু মাইতি ও ইন্দ্রজিৎ কর্মকার। ঘটনার দু’বছর পরে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে এই মামলার চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। কিন্তু এখনও পলাতক অভিযুক্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ করা হয়নি। ফলে, মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন নিহতের পরিজনরা।
ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “পলাতক অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে। আমরা ঝাড়খণ্ড পুলিশর সঙ্গেও যোগাযোগ করছি। পলাতকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।”